Pages

Sunday, July 29, 2012

বেড়ানো: যেতে যেতে বড় ডেইল


Details
বামে আকাশ ছোঁয়া পাহাড় আর ডানে সাগরের গর্জন। মাঝে সদ্য পিচ করা মেরিন ড্রাইভ পথ, সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর প্রকৃতির লীলা খেলা। ভিন্ন কোনো এক নিসর্গকে সঙ্গী করে ছুটে চলা।

সে বার তিন দিন ছুটি পেয়েছিলাম। তাই ভ্রমণপিয়াসী ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা তো আর এই মোক্ষম সুযোগ হাত ছাড়া করতে পারে না। জীবন্ত কিংবদন্তি কৌতুক রাজ রবিনের প্রস্তাবে তড়িত্ গতিতে কক্সবাজারের টিকিট কাটা হলো। গাড়ি ছাড়ার সময় রাত্র ১১টা ৩০ মিনিট অথচ কাউন্টার হতে ফোন করে জানালো হলো বিশেষ কারণে সন্ধ্যা ছয়টায় গাড়ি ছাড়বে। স্নায়ু চাপ বেড়ে গেল, কারণ আমাদের অভিভাবকগণ প্রচণ্ড রাগী। দুপুর হতেই অস্থিরতায় পড়ে গেলাম। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার আগেই কী করে বের হবো। সময় বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিট, অভিভাবকদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বের হয়ে গেলাম সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। প্রচণ্ড জ্যাম, রিকশা ছেড়ে পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে সঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি ছাড়ল, কিছুক্ষণ যেতেই যাত্রাবাড়ি মোড়ে নগরের যন্ত্রণা জ্যামে আটকে গেলাম। তাতে কী! একজন দুজন করে সহযাত্রীদের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম। বাস গাইডের মাধ্যমে জানতে পারলাম, একচল্লিশ জন যাত্রীর মধ্যে ঊনচল্লিশ জন যাত্রীই কক্সবাজারের। মনে মনে ধারণা করে নিলাম যে, সহযাত্রীরা সম্ভবত অধিকাংশই ট্যুরিস্ট। সুতরাং ভ্রমণকালীন কিংবা অন্তত বিরক্তিকর যানজটের সময়টুকু যদি বাসটিকে বিনোদনের মঞ্চ বানানো হয়, তাহলে হয়তো যাত্রীদের নিকট হতে তেমন কোনো আপত্তি করা হবে না। যাত্রীরা বেশির ভাগ পুরাতন ঢাকার হওয়ায় সখ্য গড়তে খুব একটা সময় লাগল না। এরই মধ্যে উচ্ছ্বাসিত এক তরুণ ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’ গানটি গাইতে শুরু করল, তার সাথে আরও কয়েকজন সুর মেলালো। গান শেষে যখন তাকে ‘দে ছুট’-এর পক্ষ হতে মজা করার জন্য দশ টাকার একটি নোট দেওয়া হলো তখন সে আরও অনুপ্রাণিত হয়ে গাইতে শুরু করল। আমি গান শোনার চাইতে সহযাত্রীদের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করতেছি। ইতিমধ্যে সুপারভাইজার অনুরোধ করলেন, অতঃপর হালকা মেজাজে নিষেধ করলেন গায়ককে। তখন আমি ভোকালকে দিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলাম সুধীমণ্ডলী আমি আপনাদের বিনোদনের জন্য গান করছি, এতে কি আপনারা বিরক্ত? সমস্বরে আওয়াজ এল না, না, কেউ বলছে ওয়ান মোর। বেচারা সুপার ভাইজার একেবারে চুপসে গিয়ে বসে পড়ল। দাউদকান্দি গিয়ে গাড়ি ফুল ব্রেক, শুরু হলো গাওয়া ‘গাড়ি চলে না চলে না’ জনপ্রিয় গানটি। গাড়ি ধীর গতিতে চলছে, শ্রোতাদের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করলাম গুরু আযম খান কি বেঁচে আছে না মারা গেছে। সবাই বলল মারা গেছে। আপনারা ভুল বললেন, সৃজনশীলরা কখনো মরে না, বেঁচে থাকে মানুষেরই মাঝে। সবার মাঝে পিন পতন বিরবতা এল। আজ আযম খান নেই কিন্তু আছে তার গান, রয়েছে তার সুর। আপনারা এখন তারই গান শুনবেন ‘দে ছুটের’ বোতল আযমের কণ্ঠ থেকে। সবাই হাত তালি দিয়ে সম্ভাষণ জানালো। প্রথমেই শুরু করল—ওরে সালেকা/ওরে মালেকা/ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’ এভাবে একের পর এক গান করল। ‘দে ছুটের’ সফলতা এখানেই। রাতের খাবারের জন্য মিয়ার বাজার গিয়ে বিরতি দিল। খেয়ে-দেয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। সকালের এক মুঠো রোদ্দুর চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙল। খেয়ে-দেয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। সকালের এক মুঠো রোদ্দুর চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙল। জেগে দেখি চকোরিয়া, ড্রাইভার বিরতি দিতে চাইল রেস্টুরেন্টে। কিন্তু যাত্রীদের বারণ করার কারণে সোজা কলাতলি। কলাতলি মোড় আসতেই পর্যটকগণ যার যার সুবিধা অনুযায়ী নেমে পড়ছে। আমরাও একসময় নেমে পড়লাম। স্মৃতির আঙ্গিনায় স্মরণীয় হয়ে থাকল এক রাতের ভ্রমণে বাসকে মঞ্চ বানানোর গল্প। আরও মনে থাকবে সহযাত্রী রাশেদের সাল্টু তৈরির দৃশ্য। হোটেল লবিতে গিয়ে ভাবলাম খাটে একটু হেলান দিই। কারণ কক্সবাজার ব্রিজে হেঁটে বেড়িয়েছি বহুবার, ডুব দিয়েছি কতবার তা গুণেও বলতে পারব না। তা ছাড়া আমাদের মূল প্রোগ্রাম উখিয়ার পাটুয়ার টেক যাত্রা। কিন্তু হেলান দেওয়া আর হলো না, বারান্দায় যেতেই সাগরের বিশালতা হাতছানি দিয়ে ডাকল। চটজলদি লুঙ্গি ছেড়ে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে সোজা লাবণি পয়েন্টের বিচে। সখ্য হলো বর্ষা মওসুমের বিশালাকার উঁচু করে আসা ঢেউয়ের সাথে। প্রেম হলো বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির শামুক, ঝিনুকের সাথে। ভাটা শুরুর সাথে আমরাও হোটেলে ফিরলাম। দুপুরের ভোজন শেষে ঘুমের প্রস্তুতি। কিন্তু রবিনের নাক ডাকা শিল্পের কারণ আমি ঘুমাতে পারলাম না। সন্ধ্যার পর কলাতলি বিচে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ সাগর পানে চেয়ে থাকলাম আর মনে মনে ভাবলাম মানুষের হূদয় যদি এমন বিশাল হতো, তাহলে জগত্ সংসারে এত হানাহানি হয়তো হতো না। চাঁদের আলো সম্বল করে বিচের দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলাম। দৃষ্টি আটকালো ‘প্যাসিফিক ক্যাফে’ নামের লেখার উপর। বাহির থেকে ভেতরের সাজানো-গোছানো প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে ভালো লেগে গেল।
পরের দিন যেতে হবে মূল প্রোগ্রাম পাটুয়ার টেক। সদালাপী প্রান্তিক নিজ থেকেই প্রস্তাব করলেন ‘দে ছুটের’ সদস্য হওয়ার আবেদন। আমরা তার আবেদনে প্রাথমিকভাবে সাড়া দিলাম। এবার উনি বললেন পাটুয়ার টেক যখন যাবেন তাহলে আরেকটু এগিয়ে বড় ডেইল পর্যন্ত ঘুরে আসুন। নতুন কোনো জায়গার নাম শুনলে মন উত্তাল হয়ে উঠে। তাকেও সঙ্গী করলাম। এবার সে পুরোদস্তুর ‘দে ছুটের’ সদস্য হয়ে গেল। শুরু করল মজার মজার সব কাহিনি বলা। তার কথা বলার রসে আরও দুই রসিক মোস্তাক ও রবিন যেন হাবুডুবু খাচ্ছে। আসলে ভ্রমণে কেউ নরমাল থাকার চাইতে কন্ট্রোলিং ও নরমাল হলেই না তবে ঘোরার আসল মজা পাওয়া যায়। টেকনাফের শাপলাপুর বাজারে জহুরের নামাজ ও লাঞ্চের জন্য বিরতি নিলাম। সাগরের মাছ দিয়ে খুব মজা করে খেলাম। রান্নাও হয়েছে বেশ চমত্কার। গাড়ি স্টার্ট, ছুটছে গাড়ি, ডানে সাগরের উত্তাল ঢেউ আর বামে মেঘের সাথে মিতালী করা পাহাড়কে পাশ কেটে। প্রাকৃতিক গর্জন বাগান যেন মাথা উঁচু করে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে প্রহরী হয়ে আছে। গাড়ি এসে থামল বড় ডেইল ডাক ছাড়া ব্রিজে, কক্সবাজার হতে ৪৮ কিমি দূরে টেকনাফ উপজেলার অন্তর্গত। বড় ডেইল অর্থ বিশাল বালিয়াড়ি নামকরণের সাথে জায়গার সুন্দর মিল আছে। বড় ডেইলের প্রাকৃতিক পরিবেশে এত এত অপার্থিব সুন্দর যে সরেজমিনে না গেলে লিখে বুঝানো সম্ভব না। আকাশ ছোঁয়া টেবিল হিলের মতো দেখতে পাহাড়, প্রাকৃতিক বন, বুনো ক্যাকটাস উত্তাল ঢেউ, ঝাউ গাছের ঝির ঝির বাতাস যেকোনো পর্যটক বিমোহিত না হয়ে পারবে না। আমিতো ঝাউ গাছের সাথে বাঁধা দোলনায় দোল খেতে খেতে হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির মাঝে। এতটাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে, সেখানেই দিনের আলো পুরোটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

লেখক: মো. জাভেদ হাকিম

No comments:

Post a Comment