Pages

Saturday, July 28, 2012

হ্রদের সঙ্গী হয়ে…


lake

হ্রদের শান্ত পানি ঘিরে সবুজ পাহাড়। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথের এক পাশে উঁচু-নিচু পাহাড়, অন্য পাশে বিস্তীর্ণ লেক। তাতে নীলাভ জলরাশি। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো নয়; এ জল শান্ত, স্বচ্ছ ও শীতল। যত দূর দৃষ্টি যায়, মনে হবে, কোনো নিপুণ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা অপরূপ এক ছবি।
চিত্রটি চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা কাপ্তাইয়ের। বসন্তের এক ছুটির দিনের সকালে তিন বন্ধু—সুমনা, রুকু ও আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম কাপ্তাইয়ের পথে। চট্টগ্রাম শহর থেকে গাড়িতে চেপে গল্প করতে করতে কখন যে আমরা নগরের কোলাহল ছেড়ে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় এসে পড়েছি, তা ঠাওরই করতে পারিনি। যতই এগোচ্ছি, অরণ্য আর পাহাড় ততই কাছে আসতে শুরু করেছে।
চন্দ্রঘোনা কাগজকল ফেলে ছুটলাম কাপ্তাইয়ের দিকে। পথে খানিকটা যাত্রাবিরতি বন বিভাগের রেস্টহাউস ‘বনফুল’-এ। খাড়া পাহাড়ের শীর্ষে রেস্টহাউসটি এক কথায় অপূর্ব। তার চারপাশে নানা গাছগাছালি। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে কাপ্তাই হ্রদের জলধারা। ঘাটে দুয়েকটি নৌকা বাঁধা। কিছু নৌকা হ্রদের মাঝ দিয়ে চলেছে হাওয়ার তালে তালে। এখানে দেখা হয়ে গেল স্থানীয় পূর্বপরিচিত এক সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি আমাদের কাপ্তাই বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনের সুযোগ করে দেন। সেটি দেখে আমরা কাপ্তাই থেকে রওনা দিলাম আরেক পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটির পথে। সত্যিই যেন ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’। এই পথের বয়স বেশি নয়। রাস্তাটি তৈরি হয়েছে ২০০৯ সালে। কাপ্তাইয়ের পাহাড়ি এলাকা ধরে এটি এঁকেবেঁকে রাঙামাটির সঙ্গে মিলে দুই অঞ্চলের মাঝে এক নিবিড় সেতুবন্ধন রচনা করেছে। এই পথের সৌন্দর্যই আলাদা। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে হ্রদ। নগরজীবনের কোলাহলের ছিটেফোঁটাও এখানে নেই। বসতি নেই, লোকালয় নেই। কেবল গাছপালা, পাহাড় আর অরণ্য। চারপাশের নির্জনতা ভেঙে মাঝেমধ্যে পাখপাখালির মিষ্টি শিস। বসন্তের কোকিলও চুপ ছিল না। সমানে ডেকে যাচ্ছিল কুহু কুহু।
হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম হ্রদের ধারে। সেখানে একটি আদিবাসী পরিবারের বাস। তাদেরই প্রযুক্তিতে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে আমরা ঘাটে নামলাম। সেখানে দুটি নৌকা বাঁধা। ছোট নৌকাটিতে বসে বৈঠা হাতে নিল সুমনা। সে পাহাড়ি মেয়ে। এখন শহরের বাসিন্দা হলেও এই মুহূর্তে শৈশব ও কৈশোর এসে যেন ধরা দিল তার হাতের মুঠোয়। তার উচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে আমরা দুই আনাড়িও নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা তীর ঘেঁষে ধীরে ধীরে চলছে।
নৌ-ভ্রমণ করতে করতেই বেলা পড়ে গেল। এবার গন্তব্য রাঙামাটি। যত দূর পথ চলি, নির্জনতা কেবল বাড়তে থাকে। বসন্তের প্রকৃতি কিছুটা নিস্তেজ, বর্ষার সজীবতা এখানে উধাও। প্রকৃতিতে এখন মাতাল হাওয়া। পথে কেবল শুকনো খসখসে পাতার মর্মরধ্বনি। মাঝেমধ্যে দেখা যায় দু-একটি আদিবাসী বাড়ি। দীর্ঘ হ্রদের ধার ঘেঁষে আমরা যাচ্ছি। এই হ্রদেই ছিল চাকমা রাজার আদি বাড়ি। কাপ্তাই বাঁধের কারণে তা ডুবে যায় লেকের অতল জলে। আমরা তবলছড়িতে যখন পৌঁছাই, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সুমনার মায়ের বাড়িতে দুপুরে খাবারের আয়োজন। ছোট বোন মিনি কত রান্না করল! সাদা ভাত, ভর্তা, শাকসবজি, হ্রদের তাজা মাছ ভাজি, কচি লাউ, চিংড়ি, মুরগি—এসব। খেলাম পেট পুরে। মিনি আবার বিন্নি চালের পিঠাও বানাল। ওদের যখন বিদায় জানালাম, রাঙামাটির পাহাড়ি শহরে তখন সন্ধ্যা নামছে। সূর্যের লালিমা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ের আড়ালে। সন্ধ্যার মায়াবী পর্দা দুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও নেমে আসছিলাম পাহাড়ি শহর ছেড়ে। সারা দিনের নির্ভেজাল ও নিঃস্বার্থ আনন্দধারাকে সঙ্গী করে যতই পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসছিলাম, ততই স্মৃতির ভান্ডারে জমে থাকা প্রতিটি ক্ষণ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মতো। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলো ফিরতি পথে যুক্ত করল বাড়তি পাওনা। এই আলোর ধবল রোশনাই পাহাড় আর অরণ্যে ছড়াল অন্য রকম সুষমা।
ডেইজী মউদুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২২, ২০১১

No comments:

Post a Comment