আমের এখন ভরা মৌসুম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাটে, বাজারে, গাছের ডালে ডালে সর্বত্রই আম আর আম। দেশের সবচেয়ে বেশি আমের উত্পাদন এ জেলাতেই। এ ছাড়া প্রাচীন গৌড়ের নানান ঐতিহাসিক স্থাপনাও আছে এ জেলাতে। আমের এ মৌসুমে চলুন ঘুরে আসি উত্তর বঙ্গের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর :মহানন্দা নদীর তীরে বেশ পুরোনো শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ। প্রতিদিন সকালে এ সময়ে দূরদূরান্ত থেকে আম বোঝাই নৌকা ভিড় জমায় শহরের থানা ঘাটে। খুব ভোরে শুরু হয়ে এ বাজার বেলা উঠার কিছু পরেই শেষ হয়ে যায়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দিনে দিনে নৌকার সংখ্যা কমে আসছে এ বাজারে।
কোতোয়ালি দরজা :ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশ পথে অবস্থিত। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়াল-এর অনুকরণে এর নামকরণ। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশ পথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলো দিয়ে শত্রুর ওপরে গুলি কিংবা তীর ছোড়া হতো বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোতোয়ালি দরজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ, এটি ভারতের অংশে পড়েছে।
খনিয়াদিঘি মসজিদ :সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আম বাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত মসজিদটি। ইটের তৈরি এ মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। প্রার্থনা কক্ষের ঠিক ওপরে বিশাল আকারের এ গম্বুজটির অবস্থান। মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষের বাইরে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মূল মিহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটা আচ্ছাদিত ছিল। যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান। খনিয়াদিঘি মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যিক রীতির বিচারে ঐতিহাসিকগণ এটিকে পরবর্তী ইলিয়াস ইলিয়ামশাহী আমলে ১৪৮০ সালের দিকে নির্মিত বলে মনে করেন। মসজিদের পূর্ব দিকেই রয়েছে রয়েছে প্রাচীন আমলের খনিয়াদিঘি। এ কারণেই এর এরূপ নামকরণ। তবে এ মসজিদের অন্য একটি নাম হলো রাজবিবি মসজিদ।
ধুনিচক মসজিদ :খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদ। মসজিদটির উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল এবং ভেতরের পাথরের স্তম্ভ এখনো টিকে আছে। ছাদ এবং পূর্ব দেয়াল পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইটের তৈরি এ মসজিদটি আয়তাকার। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এ মসজিদটিও পনের শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।
দরসবাড়ি মাদ্রাসা :সোনা মসজিদ স্থল বন্দরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ। চার পাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাটিতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙ্গিনার চার পাশে ঘিরে ছিল ৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান। এ কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে পরীক্ষামূলক খনন কাজ চালায়। আর সে খননের ফলেই আবিষ্কৃত হয় মাদ্রাসাটির ভিত্তির। শিলালিপি থেকে জানা যায়, মাদ্রাসাটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন। দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র। আর দরসবাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
দরসবাড়ি মসজিদ :দরসবাড়ি মাদ্রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় মসজিদটি। এর বাইরের দিকের পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ২০.৬ মিটার। আর ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য ৩০.৩ এবং প্রস্থ ১১.৭ মিটার। মসজিদটির ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ।
মসজিদটির ছাদ বহু আগেই ধসে পড়েছে। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের স্তম্ভগুলো। কারুকার্য খচিত মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের মিহরাবগুলো এখনো টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। দরসবাড়ি মসজিদে এখন নামাজ আদায় হয় না। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এটি একটি নামমাত্র সংরক্ষিত স্থাপনা।
তাহ্খানা :সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে কিছুটা ভেতরের দিকে বিশাল একটি দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্ব দক্ষিণেরটি হলো তাহ্খানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহসুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারও কারও মতে শাহসুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।
ছোট সোনা মসজিদ :তাহ্খানা থেকে পূর্ব পাশে প্রধান সড়ক লাগোয়া অবস্থিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তার রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।
মসজিদটির মূল ভবনটি আয়তাকার। বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি রয়েছে। এখানে কারা সমাহিত হয়েছেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিক কানিংহামের মতে, সমাধি দুটিতে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে। যার একটিতে সমাহিত আছেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
কানসাট বাজার :সোনা মসজিদ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফেরার পথে পড়বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দূরদূরান্ত থেকে সাইকেল কিংবা রিকশা ভ্যানে করে আম নিয়ে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকেন আমচাষিরা। বাজারটি ঘুরে দেখতে পারেন। কানসাট বাজারে এখন নানান প্রজাতির আমের সমাগম হয় প্রতিদিন। হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, খিরশাপাত, কহিতোর, দুধসর, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা এ বাজারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তবে ফজলি, আশ্বিনা মৌসুমের সর্বশেষ আম। এগুলো বাজারে আসবে আরও পরে। কানসাট বাজারে এ বছরে আমের মূল্য ১৬০০ টাকা-২৬০০ টাকা মণ। এ বাজারে প্রতি ৪৮ কেজিতে মণ।
শিবগঞ্জের আম বাগান :চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে পিছে ফেলে মহানন্দা সেতু পেরিয়ে সোনা মসজিদ স্থল বন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু আম বাগান আর আম বাগান। গাছের ডালে ডালে মাটি ছুঁই ছুঁই আম ঝুলে থাকতে দেখা যাবে। পছন্দের যেকোনো বাগানে নেমেই ঘুরে দেখতে পারেন। তবে শিবগঞ্জের সবচেয়ে পুরোনো আমের বাগানটি দেখতে ভুলবেন না। এর নাম ‘রাজার বাগান’। কানসাট বাজার থেকে সোনা মসজিদের দিকে যেতে প্রথম কালভার্টটির ডানে মেঠোপথে প্রায় বিশ মিনিট হাঁটলেই এ বাগানের দেখা মিলবে। জানা যায়, এ বাগানটি ছিল পুঠিয়ার রাজাদের। প্রায় একশ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে এ বাগানটিতে রয়েছে অনেক পুরোনো আম গাছ।
কীভাবে যাবেন :রাজধানী থেকে সরাসরি সড়কপথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে মডার্ন এন্টারপ্রাইজ (০১৭১১২২৮২১৭), ন্যাশনাল ট্রাভেলস (০১৭১১২২৮২৮৬), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০১৮১৩০৪৯৫৪৩), লতা পরিবহন, দূরদূরান্ত পরিবহন ইত্যাদি বাসগুলো সরাসরি যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে এ পথের বাসগুলো। ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে যাবার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৩৫-৪০ টাকা। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভোলাহাটের বাসও ছাড়ে। ভাড়া ৫০-৬০ টাকা।
কোথায় থাকবেন :চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তি মোড়ে হোটেল আল নাহিদ (০৭৮১-৫৫৭০১-৩, ০১৭১৩৩৭৬৯০২), আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), লাখেরাজপাড়ায় হোটেল রাজ (০৭৮১-৫৬১৯৩), একই এলাকায় হোটেল রংধনু (০৭৮১-৫৫৮০৭)। এ ছাড়াও আরও বেশকিছু হোটেল আছে এ শহরে। এসব হোটেলে ২০০-১০০০ টাকায় অবস্থান করা যাবে।
লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা :মুস্তাফিজ মামুন
তথ্যসূত্র: দেখুন বাংলাদেশ, অবসর প্রকাশনী
No comments:
Post a Comment