কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত ৩৬২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ এটি। এর পশ্চিমে কুতুবদিয়া দ্বীপ ও বঙ্গোপসাগর, পূর্বে চকোরিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলা, দক্ষিণে কক্সবাজার সদর ও বঙ্গোপসাগর এবং উত্তরে চকোরিয়া উপজেলা।
ঐতিহাসিকগণের মতে শিবের অপর নাম ‘মহেশ’ অনুসারে জায়গাটির নামকরণ। জনশ্রুতি আছে কোনো এক কালে এক কৃষক বনের ভেতরে একটি শিলা-বিগ্রহ খুঁজে পান। স্বপ্নযোগে তিনি জানতে পারেন যে, এটি ‘মহেশ’ নামের এক হিন্দু দেবতার বিগ্রহ। পরে তিনি একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে বিগ্রহটি স্থাপন করেন। পর্তুগিজ পর্যটক সিজার ফ্রেডারিকের মতে ১৫৫৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহেশখালী দ্বীপের সৃষ্টি। মহেশখালী চ্যানেল ও বাঁকখালী এখানকার উল্লেখযোগ্য নদী।
মহেশখালী বাজার :মহেশখালী চ্যানেল পেরিয়ে জেটি ধরে সোজা সামান্য পশ্চিমে মহেশখালী উপজেলা শহর। মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এ শহরটিতে দেশের অন্য দশটি উপজেলা শহরের মতোই। তেমন কোনো দর্শনীয় স্থান না থাকলেও শহরটি ঘুরে দেখতে পারেন।
বৌদ্ধ কেয়াং :মহেশখালী জেটি থেকে বাজারে প্রবেশের আগেই সড়কের বাঁ পাশে মহেশখালী বড় বৌদ্ধ কেয়াং বা মন্দির। এর ভেতরে আছে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির। বেশ কয়েকটি পিতলের বৌদ্ধ মূর্তির দেখা মিলবে এ কেয়াংয়ে। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ মূর্তি, মাথায় হাতে শায়িত বুদ্ধ এবং দণ্ডায়মান বুদ্ধ মূর্তি ইত্যাদি।
আদিনাথ মন্দির :মহেশখালীর গোরখঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পায় ৮৫ মিটার উচ্চতায় মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ১০.৫০ মিটার, প্রস্থ ৯.৭৫ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। মন্দিরটির আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরের অংশ সবচেয়ে পুরনো। আদিনাথ মন্দিরের পাশেই অষ্টভূজা নামে আরেকটি বিগ্রহের মূর্তি আছে। উত্তরের অংশের প্রথম ভাগে বর্গাকারের দুটি পূজাকক্ষে আদিনাথ বাণলিঙ্গ শিবমূর্তি এবং অষ্টভূজা দুর্গামূর্তি রয়েছে। সামনের দিকের প্রবেশপথটি ধনুকাকৃতির।
আদিনাথের মেলা :বহুকাল ধরে আদিনাথ মন্দিরকে কেন্দ্র করে চলে আসছে আদিনাথের মেলা। ধারণা করা হয় মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ মেলার প্রচলন। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে অর্থাত্ শিব চতুর্দশী উপলক্ষে এ মেলার আয়োজন হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও ভারত, নেপাল, মায়ানমারসহ আরো অনেক দেশ থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের সমাগম হয় এ মেলা উপলক্ষে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীদের মেলা হলেও সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী এ আয়োজনে সব ধর্মের লোকজনের সার্বজনীন মেলায় পরিণত হয়।
কক্সবাজারের কস্তুরীঘাট থেকে স্পিড বোটে মহেশখালী যেতে সময় লাগে বিশ মিনিট। জনপ্রতি ভাড়া ৮০-১৫০ টাকা। এ ছাড়া ইঞ্জিন নৌকায় গেলে সময় লাগে এক ঘণ্টার মতো। ভাড়া ৩০-৫০ টাকা। যারা সরাসরি আদিনাথ মন্দিরে যেতে চান কস্তুরীঘাটে থেকে তাদের যেতে হবে গোরখঘাটা।
সোনাদিয়া :মহেশখালী উপজেলার অধীন ছোট্ট একটি দ্বীপ সোনাদিয়া। প্রায় নয় বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপটি উপজেলার হোয়ানাক ইউনিয়নে অবস্থিত। মহেশখালী থেকে সোনাদিয়ার অবস্থান দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। পর্যটন শহর কক্সবাজার থেকে সমুদ্র গর্ভে সোজা পশ্চিমে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে সোনাদিয়া। এ দ্বীপের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহজেই মানুষের মন কাড়ে। একদল জীবন সংগ্রামী জেলেদের বসবাস এ দ্বীপে। আর এ কারণেই পুরো দ্বীপ জুড়ে চোখে পড়ে শুঁটকি উত্পাদনের দৃশ্যাবলী। শ্বাসমূলীয় বা ম্যানগ্রোভ বনেরও দেখা মিলবে সোনাদিয়ায়। এ ছাড়া নির্জন সমুদ্রসৈকত, তীরে তার ঝাউ বন। দূর দিগন্তে মিশে যাওয়া সাগরের নীল জল, কী নেই এখানে? একটু নির্জন বলেই হয়তো লাজুক লাল টুকটুকে কাঁকড়াদের অভয়াশ্রম সোনাদিয়ার সাগর সৈকত। কোথাও কখনো কখনো লাল কাঁকড়ারা সৈকত রাঙিয়ে বিচরণে নামে। পর্যটকদের পদধ্বনি শুনে হুটোপুটি আবার গর্তে লুকোয়।
কীভাবে যাবেন :মহেশখালী যেতে হলে আগে পৌঁছুতে হবে কক্সবাজার। সড়কপথে ও আকাশপথে ঢাকা থেকে সরসরি কক্সবাজার আসা যায়। এ পথে গ্রিন লাইন, সৌদিয়া, সোহাগ, হানিফ, টি আর ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার তাপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাস চলাচল করে। ভাড়া ১১৫০ টাকা ১৫৫০ টাকা। এ ছাড়া এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী, ইউনিক, ঈগল, হানিফ, ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাসও চলে এ পথে। ভাড়া ৬০০-৭৫০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান, ইউনাইটেড এয়ার ও জিএমজি এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারের বিমানে সরাসরি যেতে পারেন কক্সবাজার। কক্সবাজারের কস্তুরীঘাট থেকে মহেশখালী যাবার উপায় আগেই বলা হয়েছে। তবে এ পথ কেবল ব্যবহার করা যাবে শীত মৌসুমে। বর্তমানে অন্যান্য মৌসুমেও সড়কপথ ব্যবহার করে মহেশখালী, সোনাদিয়া ও ধলঘাটা বেড়াতে যাওয়া সম্ভব। এজন্য চকোরিয়া হয়ে বদরখালী সেতু পেরিয়ে সরাসরি যেতে হবে মহেশখালী। এ পথে ভালো কোনো বাস সার্ভিস নেই। তাই রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
কোথায় থাকবেন :কক্সবাজারে থাকার জন্য এখন প্রচুর হোটেল রয়েছে। ধরন অনুযায়ী এসব হোটেলের প্রতি দিনের রুম ভাড়া ৩০০-২০০০০ টাকা। পাঠকদের সুবিধার জন্য নিচে কয়েকটি হোটেলের ফোন নম্বর দেওয়া হলো। কক্সবাজারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রয়েছে হোটেল শৈবাল, ফোন :৬৩২৭৪। মোটেল উপল, ফোন :৬৪২৫৮। মোটেল প্রবাল, ফোন :৬৩২১১। মোটেল লাবনী, ফোন :৬৪৭০৩। পর্যটন করপোরেশনের ঢাকাস্থ হেড অফিস থেকেও এসব হোটেলের বুকিং দেওয়া যায়। যোগাযোগ :৮৩-৮৮, মহাখালী বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা। ফোন- ৯৮৯৯২৮৮-৯১। এ ছাড়া অন্যান্য হোটেল হলো হোটেল সি গাল, (পাঁচ তারা), ফোন :৬২৪৮০-৯১, ঢাকা অফিস ৮৩২২৯৭৩-৬। হোটেল সায়মন, ফোন :৬৩২৩৫, ঢাকা অফিস ৮৬১৪৫৬৫। হোটেল সি কুইন, ফোন :৬৩৭৮৯, ৬৩৮৭৮। হোটেল সাগর গাঁও লি. ফোন :৬৩৪৪৫, ৬৩৪২৮। সুগন্ধা গেস্ট হাউস, ফোন :৬২৪৬৬। জিয়া গেস্ট ইন, ফোন :৬৩৯২৫। হোটেল সি হার্ট, ফোন :৬২২৯৮। হোটেল ডায়মন্ড প্লেস এন্ড গেস্ট হাউস, ফোন :৬৩৬৪২। গেস্ট কেয়ার লি. ফোন :৬৩৯৩০। হোটেল প্যানওয়া লি ফোন :৬৪৪৩০। কক্সবাজারের এনডব্লিউডি কোড-০৩৪১। মহেশখালী, সোনাদিয়া ও ধলঘাটায় থাকার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। কক্সবাজার থেকে দিনে দিনে ঘুরে আসতে হবে জায়গাগুলো থেকে। তবে সোনাদিয়া ও ধলঘাটা ভালোভাবে ঘুরে দেখার জন্য অবশ্যই নিরাপদ কোনো জায়গায় তাঁবু বাস করতে পারেন।
প্যাকেজ ভ্রমণ :কক্সবাজার থেকে উপরের জায়গাগুলোতে নিয়মিত প্যাকেজ ট্যুর পরিচালনা করে ভ্রমণসংস্থা বিচ নেটওয়ার্ক ট্যুরিজম। এ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা :হোটেল ডায়নামিক সি পার্ল, মেরিন ড্রাইভ রোড, কলাতলী মোড়, কক্সবাজার। ফোন :০১৮২০০০৩৭৭৩।
লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন | শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১২, ১২ শ্রাবণ ১৪১৯
No comments:
Post a Comment