চারপাশে অথৈ জল আর জল, মাঝখানে টিলার উপরে ছোট্ট একটি শহর রাঙ্গামাটি। এ জনপদের প্রতিটি ইঞ্চিই যেন সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। প্রকৃতি উজার করে বিলিয়ে দিয়েছে সে সৌন্দর্য। চারিদিকে কাপ্তাই হ্রদের জলরাশির ফাঁকে ফাঁকে যেন এক টুকরা সবুজের সমারোহ কিংবা দূর পাহাড়ের গায়ে মেঘের মিতালি সহজেই মনকাড়ে পর্যটকদের। তবে এ সৌন্দর্যের মাঝে বাড়তি মাত্রা যোগ হয় বর্ষায়। হ্রদের জল কানায় কানায় ভরে ওঠে, সবুজে ফিরে আসে সজীবতা, পাহাড়ি ঝরনায় বাড়ে জলপ্রবাহ। ভরা বর্ষায় তাই চলুন রাঙ্গামাটির পথে।
রাঙ্গামাটি ভ্রমণে সবার আগেই চলুন কাপ্তাই লেক ভ্রমণে। জল বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে কর্ণফুলী হ্রদ তথা কাপ্তাই লেকের জন্ম ১৯৬০ সালে। প্রায় ১৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ লেকের স্বচ্ছ পানি আর বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। শহরের রিজার্ভ বাজার ঘাটে পাওয়া যায় কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের নানা রকম ইঞ্জিন নৌকা। ঝুলন্ত সেতুর কাছেও এ রকম অনেক নৌকা আছে। তবে সেখানে ভাড়াটা একটু বেশিই গুনতে হবে। সারা দিনের জন্য একটি নৌকা ভাড়া করে সকালে চলে যাওয়া যায় শুভলং বাজার। এখানে সেনা ক্যাম্পের পাশ থেকে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে কাপ্তাই লেকের অপার সৌন্দর্য উপভোগ কার যায়। শুভলংয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরতি পথের শুরুতেই হাতের ডানে শুভলং ঝরনা। এখন বর্ষাকাল। শুভলংয়ের ঝরনায় তাই অঝর ধারা। ঝরনার শীতল জলে শরীরটা ভিজিয়ে নিতে পারেন। কাপ্তাই লেকের দু’পাশের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলতে থাকুন। পথে দুপুরের খাবার সেরে নিতে পারেন টুকটুক ইকো ভিলেজ কিংবা পেদা টিংটিং-এ। শুরুতেই পড়বে টুকটুক ইকো ভিলেজ। কাপ্তাই লেকের একেবারে মাঝে এই ইকো ভিলেজটির সুন্দর সুন্দর কটেজে রাত কাটানোরও ব্যবস্থা আছে। এর রেস্তোরাঁটিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম পাহাড়ি খাবার। এখান থেকে রাঙ্গামাটি শহরের দিকে আসতে সামান্য কিছু পথ এগোলেই পড়বে পেদা টিংটিং। এখানকার রেস্তোরাঁটিতেও থাকে নানা রকম খাবারের সঙ্গে পাহাড়ি নানান পদের খাবার। সারা দিন কাপ্তাই লেকের এসব জায়গা ভ্রমণের জন্য একটি ইঞ্জিন বোটের ভাড়া পড়বে ১০০০-২৫০০ টাকা। তবে বর্ষায় পর্যটকের ভিড় কম বলে এ ভাড়ায় আরও ছাড় পেতে পারেন একটু দর কষাকষি করলেই। এ ছাড়া রাঙ্গামাটি শহর থেকে এখন প্রতিদিন শুভলং ছেড়ে যায় আধুনিক ভ্রমণতরী কেয়ারী কর্ণফুলী। প্রতিদিন সকালে ছেড়ে আবার বিকেলে ফিরে আসে। ফিরতি পথে টুকটুক ইকো ভিলেজ কিংবা পেদা টিংটিং-এ থাকে বিরতি। যাওয়া-আসার ভাড়া জনপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা। ফিরতি পথে ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে এসে নামুন ঝুলন্ত সেতুর কাছে। রাঙ্গামাটি শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে রিজার্ভ বাজার ছাড়িয়ে আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে রয়েছে পর্যটন কমপ্লেক্সে। এই কমপ্লেক্সের ভেতরেই রয়েছে সবার চেনা সুন্দর ঝুলন্ত সেতুটি। সেতু পেরিয়ে সামনের পাহাড়ে উঠলে কাপ্তাই লেকের বড় অংশ দেখা যায়। পুরো সেতু এলাকাই সুরক্ষিত। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বেড়াতে কোনো মানা নেই। যারা সরাসরি পর্যটন কমপ্লেক্সে আসবেন, তারা এখান থেকেই কাপ্তাই লেকে নৌ ভ্রমণ করতে পারবেন। এখানে পর্যটন কর্পোরেশনের বিভিন্ন রকম ইঞ্জিন নৌকা আছে। এ নৌকাগুলোর সার্ভিস ভালো। বাইরের নৌকায় চড়লে দরদাম করে নিন। নৌকাটা ভালো কি না পরখ করে নিন। এ ছাড়া এখানে আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান। সাম্পানে চড়ে ঝুলন্ত সেতুর আশপাশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। ঘণ্টা ১০০ টাকায় এখানে পাওয়া যাবে পাঁচজনের চড়ার উপযোগী সাম্পান।
একদিনেই উপরের জায়গা দুটি দেখা সম্ভব। পরের দিন রাঙ্গামাটিতে থাকলে দেখুন শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো। প্রথমেই চলুন রাঙ্গামাটি উপজাতীয় জাদুঘরে। শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত এ জাদুঘরে আছে রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত নানা আদিবাসীদের ব্যবহূত বিভিন্ন সময়ের নানা সরঞ্জামাদি, পোশাক, জীবনাচরণ এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্য। ছোট অথচ অত্যন্ত সমৃদ্ধ এ জাদুঘরটি খোলা থাকে সোম থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। শনি, রবি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতে জাদুঘর বন্ধ থাকে। জাদুঘরে বড়দের প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা ও ছোটদের দুই টাকা। উপজাতীয় জাদুঘর থেকে কাছেই রাজ বনবিহার। এ অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান এটি। এখানে আছে একটি প্রার্থনালয়, একটি প্যাগোডা, বনভান্তের (বৌদ্ধ ভিক্ষু) আবাস স্থল ও বনভান্তের ভোজনালয়। প্রতি শুক্রবার ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে চলে প্রার্থনা। রাজ বনবিহারে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারেন কাপ্তাই লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য।
রাজ বনবিহারের পাশেই কাপ্তাই লেকের ছোট্ট একটি দ্বীপজুড়ে রয়েছে চাকমা রাজার রাজবাড়ি। নৌকায় পার হয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায় এই রাজবাড়িতে। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গাছের ছায়ায় ইট বাঁধানো পথের মাথায় এ সুন্দর বাড়িটি। এখানে আরও রয়েছে চাকমা সার্কেলের প্রশাসনিক দপ্তর। শহরের এসব জায়গা দেখে হাতে সময় থাকলে আরেকবার ঢু মারতে পারেন পর্যটন কমপ্লেক্সের ঝুলন্ত সেতুতে।
কীভাবে যাবেন :ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও কমলাপুর থেকে সরাসরি রাঙ্গামাটির উদ্দেশে ছেড়ে যায় ডলফিন পরিবহন (০১৭৩১৮২৩৭২১), এস আলম (৯৩৩১৮৬৪), সৌদিয়া পরিবহন (০১৯১৯৬৫৪৮৫৭), শ্যামলী পরিবহন (৭৫৪১০১৯), ইউনিক সার্ভিস (০১৯১৮০৬৪৪৭) ইত্যাদি। ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০-৩৮০ টাকা। শ্যামলী পরিবহনের একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস ঢাকা থেকে প্রতিদিন রাত দশটায় এবং রাঙ্গামাটি থেকে সকাল সাড়ে দশটায় ছাড়ে। ভাড়া ৫৫০ টাকা। এ ছাড়া যেকোনো বাস, ট্রেন কিংবা বিমানে চট্টগ্রাম এসে সেখান থেকেও রাঙ্গামাটি আসতে পারেন। চট্টগ্রাম শহরের সিনেমা প্যালেস এবং বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি বিশ মিনিট পর পর রাঙ্গামাটির উদ্দেশে ছেড়ে যায় বিরতিহীন বাস। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ থেকে ৯০ টাকা।
কোথায় থাকবেন :রাঙ্গামাটি শহরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। পর্যটন কমপ্লেক্সের ভেতরে পর্যটন মোটেল (০৩৫১-৬৩১২৬, ঢাকা অফিস ৮১১৭৮৫৫-৯, ৮১১৯১৯২, এসি দ্বৈত কক্ষ ১ হাজার ৭২৫ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ৮০৫ টাকা)। শহরের কাঁঠালতলীতে হোটেল সুফিয়া (০৩৫১-৬২১৪৫, এসি একক কক্ষ ৯০০ টাকা, এসি দ্বৈত কক্ষ ১ হাজার ২৫০ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ৮০০ টাকা)। রিজার্ভ বাজারে হোটেল গ্রীন ক্যাসেল (০৩৫১-৬৩২৮২, ০১৭২৬৫১১৫৩২, এসি কক্ষ ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা)। কলেজ গেট এলাকায় মোটেল জজ (০৩৫১-৬৩৩৪৮, ০১৫৫৮৪৮০৭০১, এসি কক্ষ ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ৩৫০ থেকে ৭০০ টাকা)। নতুন বাস স্টেশনে হোটেল আল মোবা (০৩৫১-৬১৯৫৯, ০১৮১১৯১১১৫৮, এসি কক্ষ ১ হাজার ২০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা)। পর্যটন রোডে হোটেল মাউন্টেন ভিউ (০৩৫১-৬২৮৪৮, ০১৫৫৩৪৪০৩২৪, এসি কক্ষ ১২০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা)।
প্রয়োজনীয় তথ্য :বাংলাদেশের একমাত্র রিকশামুক্ত শহর রাঙ্গামাটি। তাই এই শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় বেবিটেক্সিতে। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে পৌরসভা নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া হলো ১০ টাকা। এ ছাড়া রিজার্ভ নিলে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভাড়া ৬০-১০০ টাকা। রাঙ্গামাটি শহর থেকে কিনতে পারেন আদিবাসীদের পোশাক, রাঙ্গামাটির তাঁতের কাপড়, আদিবাসীদের তৈরি নানা রকম হস্তশিল্প সামগ্রী ইত্যাদি। কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য ইঞ্জিন নৌকা দেখে শুনে নিন। বর্ষাকাল বলে ছাউনি আছে এমন নৌকা ভাড়া করুন। নৌকায় লাইফ জ্যাকেট আছে কি না আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন।
সঙ্গে যা নেবেন :বর্ষায় ভ্রমণ নির্ঝঞ্ঝাট করতে আপনার ট্রাভেল ব্যাগটির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। প্রথমেই ব্যাগটি হওয়া উচিত ওয়াটার প্রুফ। এমন কাপড় নির্বাচন করুন যেগুলো ভিজলে আবার সহজেই শুকিয়ে যায়। রেইন কোট, ছাতা, গামবুট, মশা নিরোধক ক্রিম, টর্চ ইত্যাদি সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
লেখা ও আলোকচিত্র মুস্তাফিজ মামুন
No comments:
Post a Comment