বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বেশ কিছু হাওড় ও বিল। বর্ষা মৌসুমে এসব হাওড়ের সৌন্দর্য বেড়ে যায় অনেক বেশি। শীতে শুকিয়ে যাওয়া হাওড়গুলো বর্ষায় জলে কানায় কানায় ভরে যায়। কোথাও কোথাও এ সময়ে সমুদ্রের মতো কূল-কিনারহীন মনে হয়। এই বর্ষায় এ রকম দু-একটি হাওড় থেকে চলুন ঘুরে আসি।
নেত্রকোনার হাওড়
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুড়ি ও কলমাকান্দা উপজেলাজুড়ে কমবেশি ৫৬টি হাওড় ও বিল আছে। শুকনো মৌসুমে হাওড়ে চাষাবাদ হলেও বর্ষায় পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। তখন এসব এলাকার একমাত্র বাহন হয় নৌকা। মোহনগঞ্জ শহর থেকে রিকশায় বাবলিকোনা গিয়ে এখানকার ডিঙ্গাপোতা হাওড়ে প্রবেশ করা যায়। এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে হাওড়ের বিভিন্ন গ্রামে যেতে পারেন। বর্ষাকালে হাওড়ের গ্রামগুলো একেকটি ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। নেত্রকোনা থেকে ইঞ্জিন বোটে তিন ঘণ্টায় যাওয়া যাবে হাওরের মাঝখানে ছোট্ট গাগলাজোড় বাজারে। সারাদিন এ বাজারে মেলে হাওড়ের নানা মাছের পসরা। গাগলাজোড় বাজারের কাছে ছোট্ট গ্রাম জালালপুরে আছে এ অঞ্চলের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব উকিল মুন্সির বসতভিটা। এ ছাড়াও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে বর্ষা মৌসুমে লঞ্চে চড়ে যেতে পারেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে। বর্ষাকালে এ পথের লঞ্চগুলো হাওড়ের পথ ধরেই চলাচল করে থাকে।
কীভাবে যাবেন :ঢাকা মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সরাসরি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ যায় বিআরটিসি, নেত্র পরিবহন, ইকোনো পরিবহন, রফরফ ইত্যাদি পরিবহনের বাস। বিআরটিসির বাস ছাড়ে কমলাপুর থেকে। আর অন্য বাসগুলো ছাড়ে মহাখালী থেকে। ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ লোকাল ট্রেন আছে। তবে তা খুবই নিম্নমানের এবং সঠিক সময়েও চলাচল করে না।
কোথায় থাকবেন :হাওর ভ্রমণে গেলে অবস্থান করতে হবে মোহনগঞ্জ থানা শহরে। এ শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের দু-একটি হোটেল হলো স্টেশন রোডে হোটেল শাপলা (০১৭১২১৩৭৬৫৯), হোটেল পাঠান (০১৯১৬৮৮৮৪৬০)। এদের কক্ষ ভাড়া ১০০-২৫০ টাকা। এ ছাড়া কয়েকজন মিলে ভ্রমণে গেলে মোহনগঞ্জ থেকে ভালো মানের একটি ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে নিতে পারেন। রাতে নিরাপদ কোনো স্থানে থামিয়ে নৌকাতেই অবস্থান করতে পারেন।
টাঙ্গুয়ার হাওড়
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়। শীতে যারা এ হাওড়ে ভ্রমণে গেছেন, বর্ষায় তাদের কাছে কিছুটা অচেনা মনে হতে পারে। শুকনো কোনো ভূমি এ সময়ে চোখে পড়ে না কোথাও। চারিদিক শুধু পানি আর পানি। কোথাও কোথাও দেখা যায় গলাসমেত ডুবে থাকা কিছু গাছ। ছোট ছোট নৌকা বেয়ে চলা হাওড়ের কিছু মানুষের ব্যস্ততা। আর দেখা মেলে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া জলসীমায় বৃষ্টিস্নাত সবুজে ভরপুর কিছু গ্রাম। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের দশটি মৌজা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের বিস্তৃতি। মৌজা দশটি হলো—জগদীশপুর, ভবানিপুর, লামাগাঁও, রামসিংহপুর, মহজমপুর, মেইন দাগ, মায়াজুড়ি, পূর্ব ভাঙ্গাচড়া, নোয়াগাঁও ও টাঙ্গুয়ার হাওড়। ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওড় এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। ছোট-বড় ১২০টি বিল রয়েছে এ হাওড়ে।
কীভাবে যাবেন :ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন (০১৭১৪৫৩৭৯১৬), মামুন পরিবহনের (০১৭১১৩৩৭৮৫১, ০১৭১৮৪৩৮৭৩২) নন-এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া এসি ৪০০-৫০০ টাকা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সড়কপথে সুনামগঞ্জের জেলাসদরের সঙ্গে সিলেটের বাস সার্ভিস আছে। সুনামগঞ্জ পৌঁছে সাহেববাড়ি ঘাট থেকে গুদারায় (পারাপারের নৌকা) আসতে হবে মণিপুরী ঘাট। সেখান থেকে মোটরবাইকে তাহিরপুর এসে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে পারেন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। এ ছাড়া বর্ষাকালে সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করেও আসতে পারেন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। ভালো মানের একটি ইঞ্জিন নৌকার প্রতিদিনের ভাড়া ৩০০০-৫০০০ টাকা। সে ক্ষেত্রে কয়েকজন মিলে ভ্রমণে গেলে সুবিধাজনক।
কোথায় থাকবেন :টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ভ্রমণে গেলে রাত যাপনের জন্য নৌকাই সবচেয়ে ভালো। এসব নৌকায় বিছানপত্র থাকে না বলে সঙ্গে অবশ্যই তাঁবু ও স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়াও হেড ল্যাম্প, রোদ টুপি, ছাতা, বর্ষাতি, প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধপত্র, পতঙ্গ নিরোধক ক্রিম ইত্যাদিও অবশ্যই সঙ্গে নেবেন। এক দিনের বেশি হাওড়ে ভ্রমণ করতে চাইলে প্রয়োজনমতো খাবারদাবার নিকটস্থ বাজার থেকে কিনে নেবেন। যারা সাঁতার জানেন না, তারা অবশ্যই সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট নিতে ভুলবেন না।
লাঙ্গলের বিল
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামের পাশেই মনোরম বিলটির নাম লাঙ্গলের বিল। এখানে বড়বাড়ি নামে ভগ্নপ্রায় একটি জমিদারবাড়ি আছে। এ বাড়ির সামনে থেকেই বয়ে চলা তিতাস নদী ধরে কিছুটা দক্ষিণে চললেই বিস্তীর্ণ লাঙ্গলের বিল। বর্ষায় তিতাস আর এ বিল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। লাঙ্গলের বিল ভ্রমণের জন্য বড় বাড়ির পাশেই পাওয়া যাবে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। ঢাকা থেকে খুব সকালে রওয়ানা হয়ে বিল ঘুরে আবার ফিরে আসা সম্ভব। নিজস্ব গাড়িতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজার থেকে বাঁয়ে ছোট সড়কে প্রবেশ করতে হবে। সেখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার চললেই পৌঁছানো যাবে জায়গাটিতে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে সিলেট কিংবা মৌলভীবাজারগামী যেকোনো বাসে চড়ে মাধবপুর বাজারে নামতে হবে। সেখান থকে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা কিংবা বেবি টেক্সি করে যাওয়া যাবে বড়বাড়ি। ঢাকা থেকে গ্রিন লাইন ও সোহাগ পরিবহনের এসি বাস সিলেটের পথে চলে। ভাড়া ৮০০-৮৫০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ প্রভৃতি জায়গা থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সিলকম পরিবহন, এনপি ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাসও সিলেট মৌলভীবাজার যায়। এসব বাসে সহজে যেতে পারলেও ফেরার সময় কিছুটা ঝক্কি পোহাতে হবে। সে ক্ষেত্রে মাধবপুর বাজারে এসে কিছু বাসে উঠতে পারবেন। তবে সহজ ভ্রমণের এ পথে নিজস্ব কিংবা রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো।
লেখক: মুস্তাফিজ মামুন | শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১২, ১২ শ্রাবণ ১৪১৯
No comments:
Post a Comment