চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সীতাকুণ্ড উপজেলা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সামান্য উত্তর পাশে সীতাকুণ্ড শহর। প্রতিবছর শিব চতুর্দশী মেলা উপলক্ষে শিবরাত্রিব্রত পালন ও শিবলিঙ্গে অর্ঘ্য নিবেদন করতে দেশ-বিদেশের লাখো হিন্দু পুণ্যার্থী জড়ো হন জায়গাটিতে। সীতাকুণ্ডের এবারের শিব চতুর্দশী মেলার শুরু ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে। চলবে তিন দিন।
মন্দিরের জনপদ সীতাকুণ্ড। সীতাকুণ্ড বাজারের ভেতর থেকে ছোট্ট একটি সড়ক চলে গেছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। বাজার থেকে প্রায় দু’ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে এর সর্বোচ্চ চূড়া। উচ্চতা প্রায় ৩৬৫ মিটার বা ১২০০ ফুট প্রায়। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পথটি বেশ দুর্গম। বাজার ছেড়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই পথটি ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। চলতি পথে এখানে দেখা যাবে শংকর মঠ, শ্মশান, গিরিশ ধর্মশালা, ননী গোপাল তীর্থ মন্দির, ভৈরব ধর্মশালা ইত্যাদি। এর পরে বেশ কিছুটা পথ ওঠার পরে আছে ভবানী মন্দির। ভবানী মন্দির ছেড়ে কিছু দূর গেলেই রয়েছে শয়ম্ভুনাথ মন্দির। এখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে সামনেই আছে ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা। ঝরনা ছেড়ে সামনের পথ খুবই দুর্গম। পাহাড় কেটে বানানো সিড়িটির ধাপগুলো বেশ উঁচু উঁচু। একটু উঠলেই হাঁপিয়ে যেতে হয়। কিছুটা পথ কষ্ট করে উঠলেই প্রাচীন দুটি বট বৃক্ষের পাশে দুটি মন্দির। পুরনো মন্দিরটির নাম বিরূপাক্ষ মন্দির। এ জায়গাটির উচ্চতা প্রায় দুই শ’ মিটার। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালে দেখা মেলে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। এখান থেকে পূর্ব দিকে পথ চলে গেছে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এখানে দাঁড়িয়ে তাকালে চারপাশের দৃশ্য বড়ই মনোহর লাগে।
প্রতিবছর শিব চতুর্দশী পূজা উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে সীতাকুণ্ডে। এ সময়ে লাখো হিন্দু ভক্তের পাহাড় বেয়ে চন্দ্রনাথ মন্দিরে ওঠার দৃশ্য দূর থেকে পিঁপড়ার সারির মতো মনে হয়। বিভিন্ন মন্দিরে পূজা ভক্তদের সবার কাছেই মূল আকর্ষণ থাকে পাহাড়ের চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দিরে। দলবেঁধে সবাই তাই ছোটেন ওপরের দিকে। কেউবা পুণ্যস্নানে নিজেকে পবিত্র করে নেন চূড়ায় ওঠার আগে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ঠিক গোড়া থেকে দুটি পথ চলে গেছে চূড়ার দিকে। শিব মেলার সময় অতিরিক্ত লোক সমাগম হয় বলে ডানের পথটি কেবল পাহাড়ে ওঠার জন্য। আর বাঁয়েরটি কেবল পাহাড় থেকে নামার জন্য ব্যবহূত হয়। যাদের পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস নেই তারাও খুব সহজেই পাহাড় চূড়ার মন্দিরে যেতে পারেন। নিজস্ব গাড়ি কিংবা সিএনজি চালিত অটো রিকশা নিয়ে ইকো পার্কের ভেতরের সড়কটি অনুসরণ করে সহজেই যেতে পারেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায়। তবে বেশিরভাগ পুণ্যার্থী হাঁটা পথটিই অনুসরণ করে থাকেন, কারণ এ পথে বেশ কয়েকটি মন্দিরের দেখা মেলে। সীতাকুণ্ডের মেলা দেখে ঘুরে আসতে পারেন সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক থেকেও। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া থেকে পূর্বদিকে নিচে নামলেই এ পার্কের শুরু। এটি দেশের প্রথম ইকো পার্ক। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ও এর আশপাশের এলাকায় ২০০৪ সালে গড়ে তোলা হয়েছে এ ইকো পার্ক। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে নানান প্রজাতির গাছপালা ছাড়াও এ পার্কের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি ছোট বড় পাহাড়ি ঝরনা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার পথটি বেশ সরু এবং দুর্গম। নিচেই খাড়া পাহাড়ের ঢাল। শিব মেলার সময় প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় বলে বেশ চাপাচাপি করে এ পথটুকু অতিক্রম করতে হয়। দয়া করে তাই কেউ তাড়াহুড়া করে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করবেন না। তাতে যেকোনো রকম বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। তা ছাড়া পাহাড়ে উঠতে, নামতে নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করুন। উল্টো পথে কখনো উঠতে কিংবা নামতে চেষ্টা করবেন না। তাতেও বিপদ হতে পারে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে গেলে সীতাকুণ্ড নামা যায়। এ ছাড়া মেলার সময় কোনো কোনো ট্রেনও সীতাকুণ্ড স্টেশনে থামে। চট্টগ্রাম শহরের অলঙ্কার মোড় থেকেও বাসে আসা যায় সীতাকুণ্ড। জনপ্রতি ভাড়া ৩০-৪০ টাকা। সিএনজি চালিত অটো রিকশা নিয়েও যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। ভাড়া পড়বে ২৫০-৩৫০ টাকা।
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে। ঢাকার বাসগুলো সাধারণত শহরে প্রবেশ করে ফয়’স লেকের সামনের সড়ক থেকেই। শহরের যেকোনো জায়গা থেকে খুব সহজেই ফয়’স লেক আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে গ্রিনলাইন (০২-৭১০০৩০১), সোহাগ (০২-৯৩৪৪৪৭), সৌদিয়া (০১১৯৭০১৫৬১০), টি আর (০২-৮০৩১১৮৯), হানিফ (০১৭১৩৪০২৬৭১) ইত্যাদি পরিবহনের এসি বিলাসবহুল বাস যায় চট্টগ্রামে। ভাড়া ৭৫০-১০৫০ টাকা। আর এস আলম, সৌদিয়া, ইউনিক, শ্যামলী, হানিফ, ঈগল প্রভৃতি পরিবহনের সাধারণ মানের বাসে ভাড়া ৩৫০-৫০০ টাকা। রেলপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের পথে মহানগর প্রভাতী ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে, চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৯টা বিশ মিনিটে, মহানগর গোধুলী ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩টায়, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে, তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত এগারোটায়। ভাড়া এসি বার্থ ৭৫৬ টাকা, এসি সিট ৪৫৫ টাকা, প্রথম শ্রেণী বার্থ ৪৫৫, প্রথম শ্রেণী চেয়ার ২৯০, স্নিগ্ধা শ্রেণী ৩৮০ টাকা, শোভন চেয়ার ১৫০, শোভন ১২৫, সুলভ ১০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান (০২-৯৫৬০১৫১-১০), জিএমজি এয়ারলাইন্স (০২-৮৯২২২৪৮) ও ইউনাইটেড এয়ার (০২-৮৯৫৭৬৪০), রিজেন্ট এয়ার (০২-৮৯৫৩০০৩)-এর বিমানে সরাসরি যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে।
কোথায় থাকবেন
সীতাকুণ্ডে থাকার জন্য ভালো মানের কোনো হোটেল নেই। সাধারণ যে কয়েকটি হোটেল আছে তাতেও মেলার সময় কক্ষ পাওয়া কঠিন। তাই ভ্রমণে গেলে চট্টগ্রামে অবস্থান করাই ভালো। চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের প্রচুর হোটেল আছে। এখানে কয়েকটি হোটেলের যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া হলো। শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় হোটেল আগ্রাবাদ (০৩১-৭১৩৩১১-৮), হোটেল পেনিনসুলা (০৩১-৬১৬৭২২, ৬১৯৮৫০)। স্টেশন রোডে হোটেল এশিয়ান (০৩১-২৮৫০৩৪৬-৮, ৮০০-২০০০ টাকায় কক্ষ আছে)। স্টেশন রোডে হোটেল সুপার (০৩১-৮৪১৪৫১-২, ৬০০-১৫০০ টাকায় কক্ষ আছে)। খুলশী এলাকায় হোটেল লর্ডস (০৩১-২৫৫২৬৭১-৪)। পাঁচলাইশ এলাকায় রওশন বোর্ডিং (০৩১-৬৫১৪১৬)। জুবিলী রোডে হোটেল টাওয়ার ইন (০৩১-৮৪২৬৯১-২)। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি এলাকাতেই আছে বিভিন্ন মানের হোটেল।
লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
No comments:
Post a Comment