Pages

Sunday, August 5, 2012

চট্টগ্রামের পথে পথে

chittagong
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম। পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালী করা এই শহরে দর্শনীয় স্থানের কমতি নেই। দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরও এ শহরেই। দু’একদিন সময় নিয়ে বেরুলেই এই শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা সম্ভব। চট্টগ্রাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে কড়চার এবারের আয়োজন-
চট্টগ্রাম গেটঃ চট্টগ্রাম শহরের শুরুতেই কর্নেলহাটে রয়েছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি চট্টগ্রাম গেট। লাল ইট আর শ্বেত পাথরে তৈরি শহরেও প্রবেশের প্রধান তোরণটির মূল নাম একে খান গেট।
ফয়’স লেকঃ শহরের পাহাড়তলীতে রয়েছে ঐতিহাসিক ফয়’স লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিনশ ফুট উঁচু এ লেকে বছরের সবসময়ই কানায় কানায় জলে পূর্ণ থাকে। চারিদিকে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে এই লেকের জলরাশি। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক ১৯২৪ সালে প্রায় ৩৩৬ একর জায়গায় কৃত্রিম এ হ্রদটি খনন করা হয়। বর্তমানে ফয়’স লেকের সাথে সঙ্গতি রেখে সেখানে কনকর্ড গড়ে তুলেছে এমিউজমেন্ট পার্ক। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সেখানে এখন রয়েছে আধূনিক মানের বিভিন্ন রাইডস। ফয়’স লেকের প্রবেশমুখেই রয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়া খানা। নানা ধরণের প্রাণী রয়েছে ছোট এই চিড়িয়াখানাটিতে।
ফিরোজশাহ লেকঃ পাহাড়তলীর ফিরোজশাহ কলোনীর পাশেই রয়েছে এ লেকটি। ফয়’স লেক খননের প্রায় চার বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯২০ সালে এ লেকটিও খনন করে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে বিল্ডিংঃ শহরের সিআরবি এলাকায় পাহাড়ের উপরে রয়েছে লাল ইটে তৈরি প্রাচীন একটি সুরম্য স্থাপনা। এ অঞ্চলের রেলওয়ের প্রধান দপ্তর হিসেবে এখনও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কোর্ট বিল্ডিংঃ লালদীঘি এলাকায় পরীর পাহাড়ে আছে ঐতিহাসিক কোর্ট বিল্ডিং। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ভেঙ্গে উপরে উঠলেই দেখতে পাবেন প্রাচীন এই ভবনটি। তবে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দিন দিন হারাতে বসেছে তার জৌলুস। একে সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করে এর কোন কোন অংশ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্মাণ করা হয়েছে নতুন স্থাপনা।
লালদীঘিঃ কোর্ট বিল্ডিং এর কাছেই রয়েছে ঐতিহাসিক লালদীঘি। লালদীঘি নামের পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাস রয়েছে লোক মুখে। এই জায়গায় অনেক আগে ছিল ছোট্ট একটি জলাশয়। ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে এই জলাশয় খনন করে রূপ দেয়া হয় দীঘিতে। দীঘির পাড়ে ছিল বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুল ফোটার মৌসুমে ফুলে ফুলে লাল হয়ে যেত দীঘির পাড়। সম্ভবত সেজন্যই এর নাম হয়েছে লালদীঘি। আবার অনেকের মতে দীঘির পূর্ব দিকে তৎকালীন সময়ে যে ম্যাজিস্ট্রেট কোট এবং ট্রেজারি বিল্ডিং ছিল দুটোরই রঙ ছিল লাল। এর পাশেই ছিল জেলখানা। তার রঙও ছিল লাল। সে সময়ে জেলখানাকে বলা হতো লালঘর। একারণেই হয়তো এ দীঘির নাম হয়েছে লালদীঘি। দীঘির উত্তর পাশে আছে জমিদার রায় বাহাদুরের স্মৃতিস্তম্ভ। লালদীঘির পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান।
ওয়ার সিমেট্রিঃ শহরের গোল পাহাড়েরর মোড় থেকে একটু সামনেই আছে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওয়ার সিমেট্রি বা কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেয়া ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ভারত, মিয়ানমার, পূর্ব এবং পশ্চিম আফ্রিকা, নেদারল্যান্ড ও জাপানের সাতশ সৈনিকের সমাধি আছে এই জায়গাটিতে। দুই ঈদ ছাড়া সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা বছরই খোলা থাকে এ জায়গাটি।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরঃ শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় রয়েছে চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। জাপানের টোকিওর পরে এশিয়ায় এ ধরণের জাদুঘরের দ্বিতীয়টি হলো এটি। এখানে আছে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর জীবনচিত্র, সংস্কৃতি ও জীবনের নানান দিকের চমৎকার উপস্থাপন।
শাহ আমানত (র) মাজারঃ শহরের লাল দীঘির পূর্ব পাশে রয়েছে এ অঞ্চলের বিখ্যাত দরবেশ শাহ আমানত (র) মাজার। ধারণা করা হয় অস্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিহার থেকে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। এখানে তিনি ছোট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন এবং জজ কোর্টে পাখা টানার চাকরি করতেন।
বায়েজীদ বোস্তামী (র) মাজারঃ শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়কের পাশে নাসিরাবাদ এলাকায় রয়েছে হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (র:) মাজার। প্রতিদিন শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এ জায়গাটি।
পাথরঘাটাঃ চট্টগ্রামের প্রধান মৎস্য বন্দর। সমুদ্র থেকে মাছ ধরার ট্রলারগুলো এসে নোঙ্গর করে এখানেই। বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক মাছের পসরা দেখতে হলে যেতে হবে এ জায়গাটিতে।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতঃ শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এখানে দাঁড়িয়ে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমান জাহাগুলোকে সন্ধ্যার পরে দেখা যায় সমুদ্রের মাঝে একটি আলো ঝলমলে শহরের মতো। বন্দর রোড ধরে গেলে নতুন এয়ারপোর্ট এলাকাটিও ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এয়ারপোর্টের সামনে কর্ণফুলী নদীর দৃশ্যটাও মনোহর। শহর থেকে পতেঙ্গার বেবিটেক্সি ভাড়া ১০০ টাকা। বাস কিংবা টেম্পুতে গেলে ভাড়া লাগবে ৩০-৩৫ টাকা।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে যেতে পারেন চট্টগামে। সড়কপথে গ্রীনলাইন, সোহাগ, সৌদিয়া, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বিলাসবহুল বাস চলাচল করে এ পথে। ভাড়া ৬০০-৬৭৫ টাকা। আর গ্রীন লাইন, এস আলম, সৌদিয়া, ইউনিক, শ্যামলী ইত্যাদি পরিবহনের সাধারণ মানে বাসে ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। রেল পথে ঢাকা- চট্টগ্রামের পথে মহানগর প্রভাতী ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটে, মহানগর গোধূলি ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩ টায়, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটে, তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত এগারোটায়। এছাড়া ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান, ইউনাইটেড এয়ার এবং জিএমজির বিমান চলাচল করে এ পথে।
কোথায় থাকবেনঃ চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের প্রচুর হোটেল আছে। এখানে কয়েকটি হোটেলের যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া হলো। শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় হোটেল আগ্রাবাদ, ফোন- ৭১৩৩১১-৮। হোটেল পেনিনসুলা, ফোন- ৬১৬৭২২, ৬১৯৮৫০। স্টেশন রোডে হোটেল এশিয়ান, ফোন- ২৮৫০৩৪৬-৮। পাঁচলাইশ এলাকায় রওশন বোর্ডিং, ফোন- ৬৫১৪১৬। জুবিলী রোডে হোটেল টাওয়ার ইন, ফোন- ৮৪২৬৯১-২।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৬, ২০১০

এই গরমে কুয়াকাটা

kuakanta
বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে সাগরকন্যাক্ষ্যাত মনোরম একটি ভ্রমণ স্বর্গ কুয়াকাটা। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার অন্তর্গত লতাচাপালী ইউনিয়নে অসাধারণ এ সমুদ্র সৈকতটির অবস্থান। কুয়াকাটার ঠিক পূর্বেই রয়েছে গঙ্গামতির বা গজমোতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পশ্চিমে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উত্তরে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের বাণিজ্য কেন্দ্র আলীপুর। সাগরের বুকে এখান থেকেই সূর্যোদয় এবং সূর্যাচ্চের মনোরম দৃশ্য দেখা যায় বলে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিবেচনায় দেশের অন্যান্য সমুদ্র সৈকত থেকে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কুয়াকাটার নামকরণ নিয়ে রয়েছে মজার ইতিহাস। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন আরাকান ছেড়ে নৌকাযোগে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। চলতে চলতে তারা বঙ্গোপসাগরের তীরের রাঙ্গবালি দ্বীপ খুঁজে পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে। সাগরের লোনা পানি ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মিষ্টি পানির জন্য তারা এখানে একটি কূপ খনন করে এবং এ স্থানের নাম দেয় কুয়াকাটা। কুয়াকাটা ভ্রমণের আদ্যোপান্ত নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৈকত বলা যায়। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এ জায়গা থেকেই সূর্যোদয় এবং সূর্যাচ্চের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। তবে সেটা সৈকতের দুই প্রান্ত থেকে। ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় সৈকতের গঙ্গামতির বাঁক থেকে আর সূর্যাচ্চ দেখা যায় পশ্চিম সৈকত থেকে। এ সৈকতের দৈর্র্ঘ্য প্রায় আঠারো কিলোমিটার আর প্রস্থে প্রায় তিন কিলোমিটার। পুরো সৈকত ঘেঁষেই রয়েছে বিচ্চীর্ণ নারিকেল বাগান। সমুদ্র সৈকতের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে গঙ্গামতির খাল। এর পরেই গঙ্গামতির সংরক্ষিত বণাঞ্চল। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের একেবারে পশ্চিম পাশে আছে জেলে পল্লী। মাছের শুটকি তৈরির বিশাল একটি এলাকাও আছে এখানে। এছাড়া পুরো সৈকতজুড়েই সারা বছর দেখা মিলবে মাছ শিকারীদের বিভিন্ন কৌশলে মাছ ধরার দৃশ্য। কুয়াকাটার পুরো সৈকতে বেড়ানোর জন্য রয়েছে মটর সাইকেলের ব্যবস্থা। একটি সাইকেলে দুইজন ভ্রমণ করা যায়।
কুয়াকাটার কুয়া
কুয়াকাটা নমকরণের উৎস প্রাচীন সেই কুয়াটি এখনো আছে। তবে অদূরদর্শী কুরুচিকর সংস্কারের ফলে এর সৌন্দর্য এবং প্রাচীন আদল নস্ট হয়ে গেছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছেই রাখাইন আদিবাসীদের বাসস্থল কেরানিপাড়ার শুরুতেই বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে রয়েছে এই কুয়াটি।
সীমা বৌদ্ধ মন্দির
কুয়াকাটার প্রাচীন কুয়াটির সামনেই রয়েছে প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মন্দির, নাম সীমা বৌদ্ধ মন্দির। প্রাচীন এই মন্দিরে রয়েছে প্রায় সাঁইত্রিশ মন ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি।
কেরানিপাড়া
সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকেই শুরু হয়েছে রাখাইন আদিবাসীদের পল্লী কেরানিপাড়া। এখানকার রাখাইন নারীদেও প্রধান কাজ কাপড় বুনন। এদের তৈরি শীতের চাদর বেশ আকর্ষণীয়।
আলীপুর বন্দর
কুয়াকাটা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় একটি মাছ ব্যবসা কেন্দ্র আলীপুর। এ বন্দর থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রলার বঙ্গোপসাগরে যায় মাছ ধরতে। আলীপুর বন্দর ঘুরে দেখতে পারেন বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক মাছের বিশাল আয়োজন।
মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে রাখাইন আদিবাসীদের আকেটি বাসস্থল মিশ্রিপাড়ায় রয়েছে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির। এ মন্দিরেই রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি। এখান থেকে কিছু দূরে আমখোলা পাড়ায় রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাখাইন বসতি।
গঙ্গামতির জঙ্গল
কুয়াকাটা সুমুদ্র সৈকত পূব দিকে শেষ হয়েছে গঙ্গামতির খালে গিয়ে। আর এখানে শুরু হয়েছে গঙ্গামতির বা গজমতির জঙ্গল। বিভিন্ন রককম গাছপালা ছাড়াও এই জঙ্গলে দেখা মিলতে পারে বন মোরগ, বানর ও নানা রকম পাখির।
ফাতরার বন
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে নদী পার হলেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এরই নাম ফাতরার বন। এ জায়গাটি অবিকল সুন্দরবনের মতো হলেও হিংস্র কোন বন্যপ্রাণী নেই বললেই চলে। বন মোরগ, বানর আর বিভিন্ন রকম পাখিই এ বনে বেশি দেখা যায়। খুবই কম পরমিানে দেখা মিলে বন্য শুকরের। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার বনে যেতে হলে লাগবে ইঞ্জিন বোট। সারা দিনের জন্য মাঝারি মানের একটি বোটের ভাড়া ১৫০০- ২০০০টাকা।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো সদরঘাট থেকে লঞ্চে পটুয়াখালী। সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী রশুটে চলাচল করে এমভি দ্বীপরাজ, সৈকত ইত্যাদি লঞ্চ। এসব লঞ্চে প্রথম শ্রেনীর দ্বৈত কেবিনের ভাড়া ৮৫০-১০০০ টাকা। পুয়ায়াখালী বাস স্টেশন থেকে প্রতি ঘন্টায় কুয়াকাটার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৬০-৭০ টাকা। এছাড়া ঢাকা থেকে লঞ্চে বরিশাল এসে সেখান থেকেও বাসে চড়ে কুয়াকাটা আসা যায়। ঢাকা থেকে বরিশাল ও পটুয়াখালীর লঞ্চগুলো ছাড়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায়। ঢাকা থেকে সরসরি বাসও চলে কুয়াকাটার পথে। কমলাপুর বিআরটিসি বাস স্টেশন থেকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ছাড়ে সরকারী পরিবহন সংস্থার বাস। আর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে কুয়াকাটার পথে চলে সাকুরা, সুরভী, দ্রুতি ইত্যাদি পরিবহনের বাস। ভাড়া ৪৫০-৫০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
কুয়াকাটায় থাকার জন্য এখন বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল আছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন হলিডে হোমস। ফোন- ঢাকা বুকিং কার্যালয়- ৮৮১১১০৯, ৯৮৯৯২৮৮, কুয়াকাটা- ০৪৪২৮-৫৬০০৪, ১৭১-০১১৪৮৩। হোটেল স্কাই প্যালেস, ফোন- ঢাকা বুকিং কার্যালয়- ৭১০০৫৯০, ০১৭১১-৫৪২৮৮১। কুয়াকাটা ০৪৪২৮-৫৬০২৬, ০১৭২৭-০৩০২৪৮। হোটেল নীলঞ্জনা ইন্টারন্যাশনাল, ফোন- ০১৭১-৩০২৪০৮৭, ০১৭১২২২-৮১৪৪। হোটেল গোল্ডেন প্যালেস, ফোন ঢাকা বুকিং কার্যালয়-০১৭১৫০৬১২০১, কুয়াকাটা- ০৪৪২৮-৫৬০০৫, ০১৭১১-৪৪১৬২২। হোটেল সাগর কন্যা, ফোন ঢাকা বুকিং কার্যালয় ৮৩১৪০৬১, ০১৭২০২০৯০২৯, কুয়াকাটা- ০৪৪২৮-৫৬০২০, ০১৭২০২০৯০২৯। এসব হোটেলে ৫০০-২৫০০ টাকায় বিভিন্ন মানের ক আছে।
কিছু তথ্য
কুয়াকাটা ভ্রমণে যাওয়ার আগে একটি কথা জেনে যাওয়া ভালো। সুন্দর এ পর্যটন কেন্দ্রটি সরকারের কাছে বরাবরই উপেক্ষিত। তাই পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সড়কের বেহাল দশার কারণে প্রায় আড়াই ঘন্টার এ পথটুকু পেরুতে কিছুটা দুর্ভোগের শিকার হন পর্যটকরা। তবে সাগরকন্যার সৌন্দর্য দেখার পরে সে কষ্ট অনেকের কাছেই সামান্য মনে হবে। কুয়াকাটার পাশ্ববর্তী দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাহন মোটর সাইকেল। পাঠকদের সুধিবার জন্য কুয়াকাটার স্থানীয় দুইজন অভিজ্ঞ গাইডের ফোন নম্বর দেয়া হলো। যোগাযোগ : ০১৭২৪০৫৫৬৫৬, ০১৭২৪৫৪২১৮০।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ৩০, ২০১০

ইছামতির তীরে

ichhamati
ঢাকার কাছেই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপনা সমৃদ্ধ একটি জায়গা নবাবগঞ্জ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এ জায়গাটিতে খুব অল্প সময়েই পৌঁছানো যায় ঢাকা থেকে। নবাবগঞ্জের মূল আকর্ষণ হলো এ এলাকার প্রাচীন কিছু জমিদার বাড়ি। চলুন তাহলে ঘুরে আসি নবাবগঞ্জ থেকে।
ইছামতি নদী
নবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ইছামতি নদী। শহরের মহাকবি কায়কোবাদ মোড় থেকে পশ্চিম দিকে কলাকোপার। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শান্ত, স্নিগ্ধ এক নদী। নাম তার ইছামতি। ছোট বেলায় ইছামতির যে রূপের বর্ণনা পড়েছিলাম এখনও যেন তার কোনো কমতি নেই বর্তমানের ইছামতির মধ্যে।
গান্ধী মাঠ
নবাবগঞ্জের কলাকোপায় রয়েছে ঐতিহাসিক গান্ধী মাঠ। সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গান্ধীজি ১৯৪০ সালে এই মাঠে এসেছিলেন। তারপর থেকে এই মাঠের নাম গান্ধী মাঠ।
আর এন হাউস
গান্ধী মাঠ ফেলে কিছু দূর সামনে এগুলেই রয়েছে প্রাচীন একটি বাড়ি। এরই নাম আর এন হাউস। ইট থেকে চুন সুরকি খসে ধ্বংসের প্রহর গুনলেও এখনো সগর্বে বাড়িটি তার জৌলুস জানান দিচ্ছে। এ বাড়ির বাসিন্দা ৮৫ বছরের হরেন্দ্র কুমার সাহা জানালেন এ বাড়ির নাম আর এন হাউস। তার দাদার বাবা রাধানাথ সাহা মুর্শিদাবাদ থেকে এসে প্রায় আড়াইশ বছর আগে এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন। চারদিকে কক্ষ ঘেরা এ বাড়ির সামনের অংশে ছিল অতিথিশালা, পেছনে অন্দর মহল এবং পাশেই মন্দির। মাঝে ছোট একটি খোলা জায়গা। বাড়ির সম্মুখভাগ বিশাল তোরণ আকৃতিতে তৈরি। আর এন হাউসের সামনে একেবারে ইছামতির তীর ঘেঁষে রয়েছে সুন্দর দোতলা একটি বাড়ি। হরেন্দ্র বাবুর বাবার ছিল লবনের ব্যবসা। লিভারপুল থেকে লবন আমদানি করতেন তিনি। সে ব্যবসার গদিঘর ছিল এ বাড়িটি।
জগবন্ধু সাহা হাউস
আর এন হাউস থেকে প্রায় এক কিলোমিটার সামনে রয়েছে আরেকটি প্রাচীন ভবন জগবন্ধু সাহা হাউস। এ বাড়ির বাসিন্দা কমলারানী জানালেন তার দাদা শ্বশুর জগবন্ধুসাহা তৈরি করেছিলেন এ বাড়ি। বিশাল আকৃতির দ্বিতল এ বাড়িটির নির্মাণশৈলী খুবই আকর্ষণীয়।
খেলারাম দাতার বাড়ি
কলাকোপা থেকে ছোট্ট একটি সড়ক চলে গেছে বান্দুরার দিকে। বান্দুরায় রয়েছে গাছগাছালিতে ঢাকা ধ্বংসপ্রায় খেলারাম দাতার বাড়ি। খেলারাম দাতাকে নিয়ে এ অঞ্চলে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। এরকম একটি হলো খেলারাম দাতা ছিলেন বিখ্যাত ডাকাত সর্দার। তবে তার দানের হাত ছিল বেশ বড়। সে ডাকাতি করে গরিব দুঃখীদের সাহায্য করত। তারই বাড়ি ছিল এটি। এ বাড়ি থেকে একটি সুড়ঙ্গ পথ ছিল ইছামতির পাড়ে। নদীপথে ধনসম্পদ এনে এ সুড়ঙ্গ পথেই বাড়িতে নিয়ে আসত খেলারাম দাতা। দোতলা এ বাড়ির নিচতলায় এখনো সুড়ঙ্গ পথটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিচতলায় অনেকগুলো কক্ষ থাকলেও এখন তার প্রায় সবই আবর্জনা আর মাটিতে ঢেকে আছে। আর দোতলায় চার পাশে ও চার কোনে চারটি করে বাংলা ঘরের আকৃতিতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আটটি ঘর। মাঝে রয়েছে মঠ আকৃতির আরেকটি ঘর। লোকমুখে শোনা যায় এঘরে অনেক মূল্যবান মূর্তি ও ধনসম্পদ ছিল।
ব্রজ নিকেতন
বান্দুরা- দোহার সড়কের পাশেই রয়েছে প্রাচীন একটি বাড়ি দুটি সুন্দর ব্রজ নিকেতন। বাড়িটির চোখ ধাঁধানো নির্মাণশৈলী দেখে যেকোনো পথিকের পা থমকে যাবে কিছুক্ষণের জন্য হলেও। সুন্দর এ বাড়িটি ঘুরে দেখতে পারেন।
জপমালা রানীর গির্জা
বান্দুরায় আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো জপমালা রানীর গির্জা। খ্রীস্টানদের এ উপসানালয়টি সর্বপ্রথম নির্মিত হয় ১৭৭৭ সালে। পরে ১৮৮৮ ও ২০০২ সালে দু বার এর সংস্কার করা হয়। গির্জার পাশেই রয়েছে খ্রীস্টনদের একটি কবরস্থান, সেন্ট ইউফ্রেটিজ কনভেন্ট নামে সিস্টারদের একটি থাকার জায়গা। একজন ফাদার ও একজন ডিকন দ্বারা পরিচালিত হয় এ গির্জার কার্যক্রম। বড়দিন, ইস্টার সানডে’তে এখানে বড় উৎসবের আয়োজন থাকে।
কিভাবে যাবেন
নিজস্ব পরিবহন নিয়ে যেতে পারলে নবাবগঞ্জের জায়গাগুলো বেড়ানো সহজ হবে। আর সে ব্যবস্থা না থাকলে যেতে পারেন বাসে করে। ঢাকার গুলিস্তান ও নয়াবাজার থেকে যমুনা, শিশির ও নবাবগঞ্জ পরিবহনের বাস চলাচল করে এই রুটে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। নবাবগঞ্জ নেমে রিকশা নিয়ে ঘুরতে পারবেন জায়গাগুলো।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ২৩, ২০১০

সমুদ্রে ভোজনবিলাস

vromon
জাহাজ থেকে দেখা স্পিডবোট কক্সবাজারের সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত তো অনেক দেখা হয়েছে। কখনো কি গভীর সমুদ্রের মাঝ থেকে দেখা হয়েছে এসব দৃশ্য? এখন এ সুযোগ করে দিয়েছে ‘কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন’ নামের এক প্রমোদতরী। কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য এটি নতুন সংযোজন। ১৩ ফেব্রুয়ারি এই কেয়ারি ক্রুজের উদ্বোধন করা হয়। প্রতিদিন সকাল ১০টায় শহরের বাঁকখালী নদীর মোহনা অর্থাৎ নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএর জেটিঘাট থেকে জাহাজটি সাগরের উদ্দেশে ছুটে চলে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সাগরে একাধিকবার প্রমোদ ভ্রমণ।
সকালে বাঁকখালী নদী থেকে যখন জাহাজটি সাগর পানে বেরিয়ে যায়, তখন দুই পাশের সবুজ প্যারাবনের সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করে। জাহাজের ছাদে দাঁড়িয়ে কিংবা কেবিনের ভেতর চেয়ারে বসে প্যারাবনের ভেতর নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ কানে বাজে। কাচঢাকা বড় জানালা দিয়ে দেখবেন সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরে আসা ট্রলার কিংবা যাত্রীবোঝাই করে মহেশখালীতে যাওয়া লঞ্চ ও স্পিডবোটের ছুটে চলার প্রতিযোগিতা।
বাঁকখালী নদী পেরিয়ে জাহাজটি মহেশখালী সাগর চ্যানেলে এলে অন্য রকম রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। ঢেউ কেটে ছুটে চলা জাহাজটা দুলবে অল্প অল্প। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জাহাজটি উত্তাল সাগরে চলার উপযোগী করে বানানো।
মহেশখালী চ্যানেল পেরিয়ে পশ্চিম দিকে একটু এগোলে সামনে পড়ে সোনাদিয়া চ্যানেল। জাহাজের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোনাদিয়া, মহেশখালী দ্বীপে বসবাসরত মানুষের জীবনসংগ্রাম, পার্শ্ববর্তী উপকূলে প্যারাবনের সৌন্দর্য দেখার মতো।
সোনাদিয়ার ভেতর দিয়ে পূর্ব থেকে উত্তর দিকে চলে গেছে বহদ্দারকাটা নদী বা খাল। ট্রলারমালিককে স্থানীয় ভাষায় বহদ্দার বলে। কোনো একসময় এই নদীতে জলদস্যুরা এক বহদ্দারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে হত্যা করেছিল। সেই থেকে নদীর নাম বহদ্দারকাটা নদী। এই নদীর উত্তর পাশে স্থাপিত হচ্ছে দেশের সর্ববৃহত্ গভীর সমুদ্রবন্দর। সোনাদিয়ার পশ্চিমে সাগরে নজরে পড়ে শত শত মাছ ধরার নৌকা। জালে আটকে পড়া মাছ ধরে বিক্রির জন্য জেলেরা ছুটছেন উপকূলের দিকে। মহেশখালী গোরকঘাটা বাজারে এই তরতাজা মাছের হাট বসে।
সোনাদিয়ার দক্ষিণ পাশে কক্সবাজার উপকূলের ফদনার ডেইল চর। এই চরেও শত শত ট্রলারের সরগরম উপস্থিতি। কেউ সাগর থেকে ধরে আনা মাছ এই চরে বিক্রি করছে, কেউ আবার ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে সাগরের দিকে ছুটছে। আকাশে দেখবেন গাঙচিল, পানকৌড়ি, সারসসহ নানা পাখির মেলা। সাগরে জাহাজের পাশঘেঁষে আসা-যাওয়া করে অসংখ্য ট্রলার। কপাল ভালো থাকলে দেখা মিলবে ডলফিনের। জাহাজের আগে যেন পথ দেখিয়ে ছুটে চলে এরা। কালো প্রজাতির এই ডলফিনকে স্থানীয় ভাষায় শুশুক বলে।
জাহাজ নিয়ে আরও একটু এগোলে সামনে পড়ে লাবণী পয়েন্ট। কক্সবাজার সৈকতের মূল পয়েন্ট যাকে বলে। এত দিন এই সৈকতে দাঁড়িয়ে সাগর দেখেছেন যাঁরা, এখন সাগর থেকে দাঁড়িয়ে তাঁরা লাবণী পয়েন্টে গোসল করতে নামা কিংবা কূলে দাঁড়িয়ে দৌড়ঝাঁপরত পর্যটক, তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়, রাডার স্টেশন, লাইট হাউস, দরিয়ানগর দেখতে পাবেন।
শহরের বাঁকখালী নদী থেকে সোনাদিয়া, লাবণী পয়েন্ট, হিমছড়ি হয়ে ইনানী সৈকত পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের সাগর পাড়ি দিতে জাহাজটির সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। আবার ফিরে আসতেও লাগে দেড় ঘণ্টা। আসা-যাওয়ার এই মোট তিন ঘণ্টার সমুদ্রদর্শনে মাথাপিছু লাগে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। সঙ্গে খাবার, চা-কফি, নাশতা সরবরাহ করা হয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে কম টাকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। বেসরকারি ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান ‘কেয়ারি ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড’ কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো পর্যটকদের সমুদ্র বিনোদনের জন্য প্রমোদতরীটি পরিচালনা করছে।
কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইনের পরিচালক এস এম আবু নোমান জানান, ৩১০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক এ প্রমোদতরীটি এখন দিনে দুবার আসা-যাওয়া করছে। ভবিষ্যতে দৈনিক চারবার (সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাত) জাহাজটি সাগরে চলাচল করবে।
আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৩, ২০১০

সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ অভিযান

honey-collection
সুন্দরবন এক ভিন্ন জগৎ। এর একেকটি রেঞ্জ ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বলিত। সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলের একটি রেঞ্জ হলো বুড়িগোয়ালিনী। তিনমাস ধরে এ রেঞ্জে চলে মধু সংগ্রহ। আর এ পেশায় যারা নিয়োজিত তাদেরকে বলা হয় মৌয়াল। প্রতি বছর মধু সংগ্রহের এ অভিযান শুরু হয় পয়লা এপ্রিল থেকে। চাইলে আপনিও পারেন কোনো এক মৌয়াল দলের সঙ্গে অভিযাত্রী হয়ে উত্তেজনাকর একটি অভিজ্ঞতা গড়তে।
প্রতিবছর বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে মৌয়ালরা সুন্দরবনে যান মধু সংগ্রহ করতে। মধু সংগ্রহের এ যাত্রা শুরু হয় কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস এ কাপড় বিপদ আপদ বিশেষ করে বাঘের হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। এরপরে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছুড়লেই সবাই বৈঠায় হাত লাগান। ছুটে চলেন বনের উদ্দেশ্যে।
গ্রীষ্মের শুরু থেকে মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করে এবং বাইন, পশুর, গেওয়া, কাঁকড়া ও সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছে মৌচাক তৈরি করে। বনে পৌঁছে এসব মৌচাকই খুঁজে বেড়ান মৌয়ালরা। মধু সংগ্রহের দলে সাধারণত সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন। যাদের একজন নেতা থাকে। নেতাকে মৌয়ালরা বহড়দাড় বলে। বহড়দাড় মধু সংগ্রহের স্থান নির্ধারণ করেন। নৌকায় একজনকে রেখে বাকি মৌয়ালদেরকে নিয়ে দা, ধামা হাতে করে মধু সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে প্রবেশ করে। আর এভাবেই মধু সংগ্রহের যাত্রা শুরু হয়।
বয়সে প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ মৌয়ালরা বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন। যদি চার মিটার উচ্চতায় মৌমাছি উড়তে বা গাছের পাতায় মৌমাছির মল দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে আশেপাশেই মৌচাক রয়েছে।
আপনিও খুব কাছ থেকেই দেখতে পারেন মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। আর এজন্য আপনাকে সাহায্য নিতে হবে কোনো অভিজ্ঞ ভ্রমণ সংস্থার। এ প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যটকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় মৌয়ালদের সঙ্গে মধু সংগ্রহের আয়োজন করে থাকে। যারা পর্যটকদের প্রতিটি পদক্ষেপ সঙ্গে নিয়ে মধু সংগ্রহের কৌশল দেখাবে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ কোনো ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। প্রতি বছরের মতো এবারও বেঙ্গল ট্যুরস মধু সংগ্রহের বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ সেই প্যাকেজ ভ্রমণে গিয়ে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে শুরু হবে এ প্যাকেজ। ৫ রাত ৪ দিনের এ প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ হবে ৯৫০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১১৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরা। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব ভ্রমণ তরীতে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ: বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, ব্লক-এ, বনানি, ঢাকা। ফোন: ৮৮৫৭৪২৪, ০১৭১৩০৩১৭৫৪, ০১৭১৫০১০৬০১।
আলোকচিত্র রফিকুল ইসলাম নাসিম
মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ০৯, ২০১০

মাছ-পাখির অভয়াশ্রমে

pakhi
কালিম পাখি ‘ঠক-ঠক-ঠক, ঠকাঠক…’ সাতসকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চোখ কচলে ঘড়ি দেখি, এত সকালে কড়া নাড়ে কে? দরজা খুলে দেখি ষাটোর্ধ্ব এক লোক দাঁড়িয়ে। নাম গফুর মিয়া। তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তাঁর বাহন আমাদের পৌঁছে দেবে হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে। এই বিল দেখতেই রাতে পৌঁছেছি শ্রীমঙ্গল শহরে।
অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম বাইক্কা বিলে যাব। পাখি দেখব, ছবি তুলব। শেষে ইচ্ছে ও সময়ের সম্মিলন ঘটে এবারের ফেব্রুয়ারির শুরুতে।
আমরা তিন বন্ধু ঢাকা থেকে রওনা হই। রাত চারটায় শ্রীমঙ্গলের চৌমাথায় নামি। শীত প্রায় শেষ, তবু এখানে ঠান্ডা ভাব টের পেলাম। ঘুম ঘুম চোখে পথে নামলাম। হেঁটে হেঁটে হোটেল প্লাজায় উঠি। আমাদের বাহন পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু দুই চোখ। একসময় অটোরিকশার ঝাঁকুনিতে সজাগ হলাম। একসময় পিচের পথ ছেড়ে মেঠো পথ ধরে চলা শুরু করলাম। বাইরে তাকাতেই চোখ থেকে ঘুম পালাল। রাস্তার দুপাশেই অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ! কৃষক ক্ষেতে বীজ রোপণে ব্যস্ত। রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে মাঠে চলেছে। গরুর পাল একটু পরপরই আমাদের পথ আগলে দাঁড়াচ্ছিল। ক্যামেরা হাতে নেমে পড়ছিলাম বারবার। জেলেদের ছোট ছোট দল কাঁধে মাছ ধরার জাল, পিঠ কিংবা মাথায় মাছের ঝুড়ি, আবার কেউ কেউ বইঠা হাতে চলেছে। একদল কিশোর-কিশোরী সেই সক্কালে গোল্লাছুট খেলায় মত্ত। এসব দেখতে দেখতে একসময় থেমে যায় আমাদের বাহন। হিজল ও করচ বনের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। পুরো এলাকায় ঢোলকলমির সমারোহ। বছরের এই সময়ে কেমন যেন রুক্ষ চারপাশ। ঘাসগুলো মরে লালচে হয়ে আছে। প্রকৃতি যেন বৃষ্টির অপেক্ষায়।
এবার বাইক্কা বিলে পৌঁছে গেছি। শত-সহস্র পাখির সমাহার। বিলের মাঠ একদিকে সাদা, আরেক দিকে নীল। সাদায় ভরিয়ে দিয়েছে বক, আর নীল করেছে কালিম পাখি। পাখিগুলোর উড়াল দেখতে দেখতে চলে যাই পর্যবেক্ষণ (ওয়াচ) টাওয়ারের কাছে। টাওয়ারের সিঁড়িতে পা রাখতেই আমাদের স্বাগত জানান আদর মিয়া। তিনি টাওয়ারের প্রধান। বাইক্কা বিল মাছের অভয়াশ্রম। সঙ্গে সঙ্গে পাখির চারণক্ষেত্র হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
দুই চোখ ভাসিয়ে দিলাম বাইক্কা বিলের বিশাল জলাশয়ে। বহু দূর বিস্তৃত বিলে কেবল পাখি আর পাখি। পদ্মপাতায় ঢাকা বিল। বাইক্কা বিলকে এ জন্য স্থানীয় মানুষ পদ্ম বিলও বলে থাকে। বর্ষায় লাল পদ্মশোভিত বাইক্কা আরও সুন্দর। আদর মিয়া বললেন, ‘শীতে বাইক্কা বিলে মানুষ খুব বেশি আসে। কিন্তু ভাইজান, বর্ষাকালে বাইক্কা বিলে বেড়ানোর মজাই আলাদা।’ আমরা তখন পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের সর্বোচ্চ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে। হাতের ক্যামেরায় দ্রুত ক্লিক করছি। একসময় নৌকা চলে এল। তাতে চড়ে বসতেই পদ্মপাতায় মোড়া জলাশয় ভেদ করে এগিয়ে চলল তরতর করে। আমাদের ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, ওপরে-নিচে পাখি আর পাখি। মাঝি মতিন মিয়া বলে চলেছেন, ‘ওই যে নিউ পিপি, দল পিপি, ধুপনি বক, ভূতিহাঁস, ইগল, ঠেঙ্গি, আর রাজ সরালি।’
আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে নৌকার মাঝি মতিন মিয়ার আক্ষেপ, ‘খুব ভোরের দিকে আর সূর্যাস্তের সময় পাখি দেখার সেরা সময়।’ মতিন মিয়া আমাদের পানির দিকে তাকাতে বললেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ডুবসাঁতারে মাছ ছুটে চলেছে। মাছেদের ধাক্কায় আমাদের নৌকা দুলে উঠছে।
যাতায়াত, থাকা-খাওয়া
ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে যেতে হয় শ্রীমঙ্গল। সেখানে আবাসিক হোটেলে ওঠা যায়। আবার শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ সড়কে লাউয়াছড়া বনের কাছে রয়েছে চা বাগানের টি-রিসোর্ট। তবে এখানে থাকলে আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে।
ফারুখ আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০২, ২০১০

ঢাকার পাশে গাজীপুর

gazipur
ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা গাজীপুর। এ জেলার উত্তরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা, দক্ষিণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে ঢাকা ও টাঙ্গাইল জেলা অবস্থিত। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে আছে বেশ কিছু বেড়ানোর জায়গা। ঢাকার পাশ্ববর্তী এসব জায়গায় ভ্রমণ নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
গাজীপুর শহরের বেশ কিছুটা আগে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে শহীদ হুরমত আলীসহ অন্যান্য শহীদদের স্মরণে ১৯৭১ সালেই নির্মিত হয় হয় এ ভাস্কর্যটি। এর স্থপতি আব্দুর রাজ্জাক। ভাস্কর্যটির উচ্চতা প্রায় একশো ফুট। আর এর দু’পাশে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১১ নং সেক্টরের ১০৭ জন এবং ৩নং সেক্টরের ১০০ জন শহীদ সৈনিকের নাম খোদাই করা আছে।
ভাওয়াল রাজবাড়ি
গাজীপুর সদরে অবস্থিত প্রাচীন এ রাজবাড়িটি। জমিদার লোক নারায়ণ রায় বাড়িটির নির্মাণ শুরশু করলেও শেষ করেন রাজা কালী নারায়ণ রায়। প্রায় পনের একর জায়গা জুড়ে মূল ভবনটি বিস্তৃত। ভবনটির দক্ষিণ পাশে মূল প্রবেশপথ। মূল প্রবেশপথের পরেই রয়েছে প্রশ্বস্ত একটি বারান্দা এবং এর পরে একটি হল ঘর। ভবনের ওপরের তলায় ওঠার জন্য ছিল শাল কাঠের তৈরি প্রশ্বস্ত সিঁড়ি। ভবনের উত্তর প্রান্তে খোলা জাগায় রয়েছে ‘নাটমণ্ডপ’। রাজবাড়ির সব অনুষ্ঠান হতো এ মঞ্চে। রাজবাড়ির মধ্যে পশ্চিমাংশের দ্বি-তল ভবনের নাম ‘রাজবিলাস’। এ ভবনের নিচে রাজার বিশ্রামাগারের নাম ছিল ‘হাওয়ামহল’। দক্ষিণ দিকে খোলা খিলান যুক্ত উম্মুক্ত কক্ষের নাম ‘পদ্মনাভি’। ভবনের দোতলার মধ্যবর্তী একটি কক্ষ ছিল রাণীমহল নামে পরিচিতি। সুরম্য এ ভবনটিতে ছোট বড় মিলে প্রায় ৩৬০টি কক্ষ আছে। বর্তমানে এটি জেলাপরিষদ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী
ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে মৃতপ্রায় চিলাই নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী। এটি ছিল ভাওয়াল রাজ পরিবার সদস্যদের সবদাহের স্থান। প্রাচীন একটি মন্দির ছাড়াও এখানে একটি সমাধিসৌধ আছে।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান
গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর থানা জুড়ে অবস্থিত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয় উদ্যানের আদলে ৬৪৭৭ হেক্টর জমিতে ১৯৭৩ সালে এ উদ্যান সরকারি ভাবে গড়ে তোলা হয়। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মূল উদ্ভিদ হলো শাল। এছাড়াও নানা রকম গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ এ উদ্যান। জাতীয় উদ্যানের ভেতরে বেশ কয়েকটি বনভোজন কেন্দ্র, ১৩টি কটেজ ও ৬টি রেস্ট হাউস আছে। উদ্যানে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৬ টাকা। এ ছাড়া পিকনিক স্পট ব্যবহার করতে হলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিং দিয়ে আসতে হবে।
সফিপুর আনসার একাডেমি
জেলার কালিয়াকৈর উপজেলায় অবস্থিত আনসার-ভিডিপি একাডেমির বিশাল চত্ত্বর বেড়ানোর জন্য একটি উপযুক্ত যায়গা। অনুমতি সাপেক্ষে বনভোজন করারও ব্যবস্থা আছে এখানে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে পারেন রেল ও সড়ক পথে। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী প্রায় সব আন্তঃনগর, কমিউটার, মেইল ট্রেনে চড়ে আসতে পারেন গাজীপুর। এছাড়া ঢাকার কাঁচপুর ও যাত্রাবাড়ী থেকে ট্রান্স সিলভা, অনাবিল, ছালছাবিল পরিবহন, লোহারপুল থেকে রাহবার পরিবহন, মতিঝিল থেকে গাজীপুর পরিবহন, ভাওয়াল পরিবহন, অনিক পরিবহন, সদরঘাট থেকে আজমিরি, স্কাইলাইন পরিবহন, গুলিস্তান থেকে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন ছাড়াও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে গাজীপুরে বিভিন রুটে। ভাড়া ৪০-৬০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে দিনে গিয়ে দিনেই শেষ করা সম্ভব গাজীপুর ভ্রমণ। তাই এখানে অবস্থান না করলেও চলে। তারপরেও শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এরকম হয়েকটি হোটেল হলো হোটেল আল মদিনা, থানা রোডে হোটেল মডার্ণ, কোনাবাড়িতে হোটেল ড্রীমল্যান্ড ইত্যাদি। এসব হোটেলে দৈনিক ১০০-২৫০ টাকায় থাকার ব্যস্থা আছে।
কিছু তথ্য
গাজীপুর থেকে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে যেতে হলে নিজস্ব পরিবহন না থাকলে জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে লোকাল বাস কিংবা টেম্পু যোগে যাওয়া ভালো। জাতীয় উদ্যানের বনভোজন কেন্দ্র ব্যবহার করতে হলে মহাখালী বন বিভাগের কার্যালয়ে এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন- ৮৮১৪৭০০। সফিপুর আনসার একাডেমিতে যেতে হলে ৭২১৪৯৫১-৯ এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের বেশি ভেতরে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করুন। একা একা কিংবা দু-তিনজন হলে বেশি ভেতরে না যাওয়াই ভালো।
আলোকচিত্র ও লেখা: মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২০, ২০১০

চা বাগানে নতুন বছর

cha-bagan
চা বাগানে নতুন বছর বৃষ্টিস্নাত হয়ে এখন নতুন রূপে সেজেছে শ্রীমঙ্গল। অনেক দিনের খরা শেষে বৈশাখের শুরুতেই বৃষ্টির দেখা পাওয়া গেল। চায়ের বাগানগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পাহাড়-টিলায় নাম জানা না-জানা গাছগুলোর ডালপালা চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির বিন্দু। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বের হওয়া ঝরনাগুলোর পানি দেখেমনে হয় যেন ঢল নেমেছে। চারদিক থেকে সবুজ-সতেজ জীবনের হাতছানি। সজীবতার এ ডাক ফিরিয়ে দেয় কার সাধ্য? বছরের প্রথম দিনটিতে তো তা উপেক্ষা করতে পারলামই না।
১ বৈশাখ ১৪১৭ বঙ্গাব্দ। একদম ভোরে শ্রীমঙ্গল-শমসেরনগর সড়ক ধরে বেরিয়ে পড়লাম। শ্রীমঙ্গল শহর ছাড়িয়ে কিছু দূর এগোলেই চেখে পড়ে ঠেলাগাড়ির দীর্ঘ লাইন। একদল শ্রমজীবী মানুষ পাহাড়ি রাস্তায় দৌড়াচ্ছে আর ঠেলা ঠেলছে। কারও ঠেলায় আনারস, কারও ঠেলায় লেবু, কাঁঠাল, কলা। তাদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গলের নতুন বাজার। ফলের পাইকারি এ বাজারটি সূর্যোদয়ের আগেই শেষ হয়ে যায়।
ডানে-বাঁয়ে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চা গাছে নতুন কুঁড়ি গজিয়েছে। বাতাসে কাঁচা চায়ের মিষ্টি একটা গন্ধ অনুভব করলাম। চা গাছের কচি গাঢ় সবুজ পাতায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা জমে আছে। একটু পরেই চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের ফাঁকে উঁকি দেবে সূর্য।
দেখতে দেখতে পুবের আকাশ অনেকটাই রাঙা হয়ে এসেছে। তারই খানিকটা আভা এসে পড়েছে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র ওপর, যেখানে ফোঁটায় ফোঁটায় জমে আছে বৃষ্টির বিন্দু। তার ওপর র্সূযের আলো পড়ে জ্বল জল করছে।
প্রকৃতি আর মানুষের সৃজিত চা বাগানের রূপলাবণ্য দেখতে দেখতে চা গবেষণাকেন্দ্রের (বিটিআরআই) রাস্তায় এসে পৌঁছালাম। চৌরাস্তার পাশেই বিশাল তিন-চারটি গাছের মগডালে পাখিদের কিচির-মিচির। দেখলাম সবুজ ঘুঘুর দল একে অপরের সঙ্গে মিতালি করছে।
ভোরের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম জেমস ফিনলে টি কোম্পানির কাকিয়াছড়া চা বাগানে। বাগানের লাইন (সারিবদ্ধ শ্রমিক বসতি) থেকে ভেসে আসছে শ্রমিক সরদারের হাঁক—‘রেন্ডি দফা দুইয়ে, দোছরা দফা সাতে…’।
হাঁক অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। তিন-চার দিক থেকে এমন হাঁক বাতাসে ভেসে আসছে। লম্বা লাঠি হাতে প্রতিটি শ্রমিক লাইনে সরদাররা ঘুরে ঘুরে সুর করে হাঁকছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে চা বাগানের নারী-শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। শত শত নারী-শ্রমিক ছড়িয়ে পড়লেন চা বাগানের চারদিকে—মাঠে মাঠে।
রাস্তার দুই পাশে নারী-শ্রমিকের পাতা তোলার ছন্দময় দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কাকিয়াছড়া পেরিয়ে ফুলছড়া চা বাগানে। সবখানেই একই দৃশ্য। চিরায়ত প্রাণের স্পন্দন।
রিকশা নিয়ে চা বাগানে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ফুলছড়া চা বাগানের বাজার থেকে রিকশা নিলাম। ভাড়া প্রতি ঘণ্টায় ৬০ টাকা।
দুপুরে সূর্য যখন মাথার ওপরে। কালীঘাট চা বাগানের বিশাল বটগাছের কাছে বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। মুড়ি, পেঁয়াজ আর কাঁচা পাতার এক কাপ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে অবসন্ন শরীরটাকে চাঙা করে আবারও পথ ধরলাম।
কালীঘাট পেরিয়ে ডিনস্টন চা বাগান। এ বাগানের বহুল পরিচিত নাম কেজুরিছড়া। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কেজুরিছড়া চা বাগানে রয়েছে ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’। খ্রিষ্টানদের এই কবরস্থানের সঙ্গে এ অঞ্চলে চা বাগানের গোড়াপত্তনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ এ কবরস্থানটিকে খুবই যত্ন করে রেখেছে।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীমঙ্গলে চায়ের আবাদ শুরু হয়। সে সময় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যেসব ব্রিটিশ সাহেব-মেম এবং তাঁদের শিশুরা মারা গেছেন, তাঁদের এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
সিমেট্রি থেকে যখন ফিরছিলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। শ্রমিকেরা মাঠ থেকে ফিরছেন। মাথায় তাঁদের কাঁচা পাতার বোঝা। সারিবদ্ধ এই ফেরা আরও একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে, যেখানে একজন বাবু (করণিক) পাতার ওজন মেপে নামের পাশে লিখে রাখবেন। ওখানে পাতা বুঝিয়ে দিয়ে তবে নারী-শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরবেন।
ফিরতি পথে চা বাগানে সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম। আস্তে আস্তে চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সূর্য ডুবছে। একসময় টকটকে লাল সূর্যপিণ্ড দিগন্ত বিস্তৃত সমান্তরাল চা গাছের আড়ালেই যেন হারিয়ে গেল। গাঢ় সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত। আমাদের পতাকাকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়।
চা বাগানে সবুজের মধ্যে শেষ হলো বাংলা বছরের প্রথম দিনটি। সারা বছর যদি এভাবেই কাটত!
কোথায় থাকবেন কীভাবে থাকবেন
শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে বেড়াতে হলে সবচেয়ে ভালো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে চা গবেষণা কেন্দ্র ও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের দুটি রেস্ট হাউস। আর আছে চা বোর্ডের টি রিসোর্ট। এ তিনটিই চা বাগানের মধ্যে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরে থাকার ভালো আবাসিক হোটেল রয়েছে। আছে গেস্ট হাউস। ৫০০-৬৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় এসব আবাসিক হোটেল, রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস পাওয়া যাবে। তবে মনে রাখবেন, ভ্রমণের অন্তত এক সপ্তাহ আগে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আর আগেই বলেছি, রিকশা নিয়ে চা বাগানে ঘোরার মজাই আলাদা। ৬০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া শহরের পেট্রলপাম্প মোড়ে কার-মাইক্রোবাস ভাড়া পাওয়া যায়। সারা দিনের জন্য দূরত্ব বিশেষে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।

সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে

kapotakh-nod
কার কাছে যেন শুনেছিলাম গল্পটা। এক আগন্তুক বাংলার কোনো এক গাঁয়ে গিয়ে এক লোকের কাছে জানতে চাইলেন, এখানে কপোতাক্ষ নদ কোথায়। লোকটি আগন্তুককে বললেন, যে নদীতে দেখবেন কোনো পালতোলা নৌকা চলে না, ধরে নেবেন সেটাই কপোতাক্ষ নদ।’
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সেই নদ দেখব, এমন আশা অনেক দিনের।
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’
কবির লেখা এ লাইন দুটো যেন মনে গেঁথে ছিল। হঠাৎ করেই সুযোগ জুটে গেল। সিইজিআইএস থেকে পরিবেশ গবেষণার কাজে যেতে হয়েছিল যশোর। আর বেশ কটা দিন পথ চলতে হয়েছিল সেই কপোতাক্ষের বাঁকে বাঁকে। সে কথাই লিখছি।
যশোর নেমে যাত্রা করলাম গঙ্গানন্দপুর গ্রামের উদ্দেশে। গ্রামের ভেতর পায়ে হেঁটে ২০ গজ এ গানোর পরই প্রথমে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে দেখা। নদীতে কচুরিপানা থাকে জানি, কিন্তু কপোতাক্ষ নদে কচুরিপানা দেখে মনে হলো এত কচুরিপানা দেশের অন্য কোনো নদীতে নেই। পালতোলা নৌকা চলবে কী করে? নদের পানি শান্ত ও স্থির। এক বৃদ্ধ তালের ডোঙায় বসে আছেন মাছ ধরার জন্য। নদের দুই পাড়েই সবুজের সমারোহ। কয়েকটা জলমোরগ ঘোরাফেরা করছে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে কচুরির বনে। পাখির ছবি তুলতে দেখে গাঁয়ের এক ছেলে আমাকে দুর্গাটুনটুনির বাসা দেখাতে নিয়ে গেল।
এবার পৌঁছলাম ঝিকরগাছা। যশোর রোড়ের বিখ্যাত সেই সব রেইনট্রির সারি প্রথমে চোখে পড়বে এখানে। ঝিকরগাছা গিয়েও নদের সেই একই রূপ। তবে এখানে কচুরিপানা আরও বেশি।
এরপর পানিসারা হয়ে হরিহরনগর যাওয়ার পথে খেজুরগাছের সারি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের সব খেজুরগাছ যেন নিয়ে আসা হয়েছে যশোরের মাঠেঘাটে। গোপালগঞ্জ যেমন তালগাছের জন্য বিখ্যাত, যশোর তেমনি খেজুরগাছের জন্য। এরপর জগিখালী, ত্রিমোহনীর পথ ধরলাম। ত্রিমোহনী এসে আরেকটি নদীর সঙ্গে দেখা হলো, নাম তার বুড়িভদ্রা। বিকেল গড়িয়ে এল। পথে নীলগলা বসন্তবৌরির ডাকে মনটা আনচান করতে থাকে। বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় এত নীলগলা বসন্তবৌরি দেখিনি। চাকলা নামের এক গ্রামে এসে দেখি রশি টানা খেয়া। নদের দুই পাড়ে খুঁটি গেড়ে এপার-ওপার রশি বেঁধে দেওয়া। নদীতে আছে নৌকা। নৌকায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ রশি টান দেয়, তাহলে নৌকা সামনের দিকে চলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ফেরার পথে প্রায় ৩০টি গরুর গাড়ির দেখা মিলল। ছেলেমেয়ে, যুবক, বুড়ো সবাই মিলে বেড়াতে বের হয়েছেন। নানা রকম সাজসজ্জা, গান ও বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে তাঁরা চলছেন।
পরের দিন সকালে সাগরদাঁড়ির পথ ধরি। কেশবপুর উপজেলায় এসে কিছুক্ষণ যশোরের হনুমানদের খোঁজ করি। কিন্তু এ যাত্রা তাদের দেখা মিলল না। ওরা দলবেঁধে অন্যদিকে চলে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসি সাগরদাঁড়ি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটায়। নদের ঘাটেই প্রথম যাই। ঘাটে নাও ভেড়ানো আছে। কয়েক ঝাঁক মাঝলা ও গো-বগ খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। দত্তবাড়ির ঘাট থেকে একটু দূরেই কবির বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাড়ি ও অন্য সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে। টিকিট কেটে কবির বাড়ি ঢুকতে হবে। বেশ কিছু বড় আমগাছ আছে বাড়িটিতে। আরও আছে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পাতিমাছরাঙা সব সময় আনাগোনা করে এ পুকুরে। বাড়ির ভেতরে আছে কবিপরিবারের ব্যবহূতসামগ্রী। যেমন—দা, আলনা, খাট, থালা, কাঠের সিন্দুক, কবির লিখিত পাণ্ডুলিপি, পারিবারিক ছবিসহ নানা কিছু।
সাগরদাঁড়ি দেখে কুমিরা, ইসলামকাঠি হয়ে আমরা তালা উপজেলায় পৌঁছালাম। পথে বেশ কিছু বিল পড়ে। শালিখা ও জালালপুর বিল এর মধ্যে অন্যতম। তালা গিয়ে কপোতাক্ষ নদে জোয়ার দেখা গেল। কিছু বড় নৌকা ছিল নদে। জোয়ারের পানিতে বেশ পলি। পলি জমে ওখানে নদ ভরাট হয়েযাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির প্রবাহ। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা গিয়ে দেখা গেল নদের পাশের কেওড়াগাছ মরে গেছে। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হলে এ গাছগুলো মারা যেত না।
কপোতাক্ষ নদের উৎপত্তি দর্শনার কাছে মাথাভাঙা নদী থেকে। এরপর চৌগাছা, ঝিকরগাছা, চাকলা, ত্রিমোহনী, জীবনগর, কোটচাঁদপুর, সাগরদাঁড়ি, তালা, কপিলমনি, বারুলী, চাঁদখালী, বড়দল, আমাদী, বেদকাশী প্রভৃতি স্থানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীর সঙ্গে মিশেছে। এখন সাগরদাঁড়ি থেকে কপিলমনিয়া পর্যন্ত হাঁটু কিংবা কোমর অবধি পানি। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা নেই বলে স্রোতও নেই। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে কপোতাক্ষের সঙ্গে গঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল বর্ষার সময় নদীতে অল্প পরিমাণ পানি আসে। এখন একমাত্র বর্ষার পানিই কপোতাক্ষের পানির প্রধান উৎস। কথিত আছে, কপোতের অক্ষের (কবুতরের চোখ) মতো স্বচ্ছ পানি বলে এ নদের নাম হয়েছিল কপোতাক্ষ। কিন্তু কপোতাক্ষের পানি আজ ঘোলা। এলাকাবাসীর অভিমত, ঠিকভাবে খনন করা হলে আবার কিছুটা হলেও সজিব হয়ে উঠবে কপোতাক্ষ। সেদিন হয়তো একটি পালতোলা নৌকার দেখা পাবেন সেই আগন্তুক।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যেতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে যশোর। এরপর যশোর শহর থেকে বাসে করে কেশবপুর। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে করে সাগরদাঁড়ি যেতে হবে।
যশোর শহর থেকে সাগরদাঁড়ি পর্যন্ত প্রায় দু্ই-আড়াই ঘণ্টা পথ। দত্তবাড়ির কাছেই আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রেস্টহাউস। সেখানে থাকতে পারেন অথবা থাকতে পারেন কেশবপুর উপজেলা ডাকবাংলোতে। তবে আগে থেকেই কথা বলে রাখতে হবে।
সৌরভ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৪, ২০১০

ঘুরে দেখি নারায়ণগঞ্জ

narayanganj
ঢাকার পার্শ্ববর্তী অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র এবং নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ। জেলার উত্তরে নরসিংদী ও গাজীপুর জেলা, দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে ঢাকা জেলা এবং পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা জেলা। এ জেলায় বেড়ানোর জায়গাগুলো নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো। ছবি তুলেছেন ও লিখেছেন মুস্তাফিজ মামুন
হাজীগঞ্জ দূর্গ : নারায়ণগঞ্জ জেলাশহরের কিল্লারপুলে অবস্থিত ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ দুর্গ। বাংলার বারভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর কেল্লা হিসেবেও অনেকের কাছে এটি পরিচিত। নদীপথে মগ ও পর্তুগিজদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মীরজুমলার শাসনামলে এ দুর্গ নির্মিত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। চতুর্ভুজাকৃতি এই দুর্গের প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাবার ফোকর।
সোনাকান্দা দুর্গ : শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দরে অবস্থিত এ জলদুর্গটি। হাজীগঞ্জ দুর্গের প্রায় বিপরীত দিকেই এর অবস্থান। নদীপথে ঢাকার সঙ্গে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ নদীপথগুলোর নিরাপত্তার জন্য মুঘল শাসকগণ কতগুলো জলদুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সোনাকান্দা দুর্গ।
বিবি মরিয়ম মসজিদ ও সমাধি : নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত এ মসজিদটি হাজীগঞ্জ মসজিদ নামেও পরিচিতি। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক ১৬৬৪-১৬৮৮ সালে নির্মিত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। মসজিদের কাছে তাঁর কন্যা বিবি মরিয়মের সমাধি রয়েছে বলেই মসজিদটির নাম বিবি মরিয়ম মসজিদ বলে অনেকে মনে করেন।
কদমরসুল দরগা : নারায়ণগঞ্জ শহরের বিপরীত দিকে শীতলক্ষা নদীর পূর্ব পাড়ে নবীগঞ্জে অবস্থিত কদমরসুল দরগা। এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কদম মোবারকের ছাপ সংবলিত একটি পাথর রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট অকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী আফগান নেতা মাসুম খান কাবুলি পদচিহ্ন সংবলিত এ পাথরটি একজন আরব বণিকের কাছ থেকে কিনেছিলেন। ঢাকার জমিদার গোলাম নবী ১৭৭৭-১৭৭৮ সালে এ সৌধটি নির্মাণ করেন। আর কদম রসুল দরগার প্রধান ফটকটি গোলাম নবীর ছেলে গোলাম মুহাম্মদ ১৮০৫-১৮০৬ সালে নির্মাণ করেন।
শীতলক্ষা নদী : নারায়ণগঞ্জের প্রধান নদী। এক সময় বিশ্বসমাদৃত বাংলাদেশের মসলিন শিল্প গড়ে উঠেছিল শীতলক্ষার দুই তীরে। এখন বিভিন্ন কলকারখানায় পরিপূর্ণ নদীর দুই পাশ। নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে শুরু করে কালীগঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ নৌ ভ্রমণে ভালো লাগবে সবার।
রূপগঞ্জ জামদানি পল্লি : শীতলক্ষার তীরে রূপগঞ্জ থানার রূপসীতে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় জামদানী পল্লি। রূপসী বাজার ও এর আশপাশে শতশত জামদানি শিল্পী দিন-রাত তাঁতে বুনেন নানা রকম শৈল্পিক জামদানি। তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে ভালো মানের জামদনি শাড়ি কেনা যায়।
মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি : নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় রয়েছে প্রাচীন একটি জমিদার বাড়ি। বর্তমানে এ বাড়িতে চলছে মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের কার্যক্রম। জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে বিশাল আকৃতির পুকুর। প্রাচীন এ প্রাসাদটি বেশ আকর্ষণীয়। প্রায় ৯৫টি কক্ষ সংবলিত এ প্রাসাদে অতিথিশালা, নাচঘর, পূজামণ্ডপ, কাছারিঘর, আস্তাবলসহ আরো বিভিন্ন অংশে বিস্তৃত।
রাসেল পার্ক : মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির পাশেই বেসরকারি একটি বনভোজন কেন্দ্র রাসেল পার্ক। নানারকম গাছ-গাছালি ছাড়াও এখানে আছে ছোট একটি চিড়িয়াখানা। সপ্তাহের প্রতিদিনই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি : নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার মোগড়াপাড়া এলাকায় অবস্থিত বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি। পাথরে তৈরি এ সমাধিসৌধটি ১৪১০ সালে নির্মিত হয়। সুলতান মারা যান ১৪০২ সালে। এ সমাধিসৌধের পূর্ব পাশের ইট-নির্মিত সমাধিটি সুলতানের প্রধান বিচারপতি কাজী সিরাজউদ্দিনের বলে অনুমান করা হয়।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন : জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগড়াপাড়া থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। বাংলার বারভূইঁয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর শাসনামলে বর্তমান সোনারগাঁও বাংলার রাজধানী ছিল। বর্তমানে এখানে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের একটি জাদুঘর ছাড়াও প্রাচীন অনেক নিদর্শন বিদ্যমান। ১৯৭৫ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। শনিবার থেকে বুধবার প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে লোকশিল্প জাদুঘর। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা, মাঝে ১২ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি। বৃহস্পতিবার লোকশিল্প জাদুঘর বন্ধ থাকে। কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে প্রবেশমূল্য দশ টাকা।
পানাম নগর : লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গোয়ালদী গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক পানামনগর। প্রাচীন এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান এখানে। পানামনগরের পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক পনাম পুল।
গোয়ালদী শাহী মসজিদ : পানামনগর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহাসিক গোয়ালদী শাহী মসজিদ। ঐতিহাসিকগণের মতে মসজিদটি ১৫১৯ সালে নির্মিত। একগম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি বাইরে পোড়ামাটির অলংকরণে সমৃদ্ধ।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের পথে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে আসিয়ান, বন্ধন, উৎসব, সেতু, আনন্দ ইত্যাদি পরিবহনের বাস। ঢাকার বায়তুল মোকাররম ও গুলিস্তান থেকে এসব বাস পাঁচ মিনিট পর পর ছেড়ে যায় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে সোনারগাঁও যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো সার্ভিস বোরাক, সোনারগাঁও ইত্যাদি। এছাড়া ঢাকা থেকে কুমিল্লা, দাউদকান্দিগামী যে কোনো বাসে উঠে মোগড়াপাড়া নেমে সহজেই আসা যায় সোনারগাঁও।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২৭, ২০১০

ঘুরে দেখা মানিকগঞ্জ

manikganj
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জ। এর উত্তরে টাঙ্গাইল জেলা, দক্ষিণে ফরিদপুর ও ঢাকা জেলা, পূর্বে ঢাকা জেলা এবং পশ্চিমে পাবনা ও রাজবাড়ী জেলা অবস্থিত। পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কালিগঙ্গা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নদী এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর তথ্য নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো। লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন মুস্তাফিজ মামুন
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
সুরম্য এ জমিদার বাড়িটি জেলার সাঁটুরিয়ায় অবস্থিত। বালিয়াটির জমিদাররা আঠারো শতকের প্রথম ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছর নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তৈরি করেন। আঠারো শতকের মধ্যভাগে জনৈক লবণ ব্যবসায়ী জমিদার গোবিন্দরাম শাহ বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন। আর ক্রমান্বয়ে তার উত্তরাধিকারীরা এখানে নির্মাণ করেন আরো বেশ কটি স্থাপনা। এখানে পূর্ববাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, উত্তরবাড়ি, মধ্যবাড়ি এবং গোলাবড়ি নামে পাঁচটি ভবন ছিল। আর জমিদারবাড়ির এ বিভিন্ন অংশ বালিয়াটি জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারী কর্তৃক তৈরি হয়েছিল। মূল প্রসাদ কমপ্লেক্সটি একই রকম পাঁচটি অংশ পৃথকভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে পূর্বের অংশটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও বাকি চারটি টিকে আছে এখনও। মূল ভবনগুলোর সম্মুখভাগে নানারকম কারুকাজ আজ মূর্তি এখনও বিদ্যমান।
বালিয়াটি জমিদারবাড়ির বিশাল কমপ্লেক্সটি উঁচু দেয়ালে চারদিক ঘেরা। এখনও টিকে রয়েছে সেই দেয়াল। এ দেয়ালের মাঝে এখন রয়েছে চারটি সুদৃশ্য ভবন। আর ভবনগুলোর সামনের বেষ্টনী দেয়ালে রয়েছে চারটি প্রবেশ পথ। চারটি ভবনের পেছন দিকে রয়েছে আরো চারটি ভবন। চারটি প্রবেশ পথের চূড়ায় রয়েছে পাথরের তৈরি চারটি সিংহমূর্তি।
রাম কৃষ্ণ মিশন
বালিয়াটি জমিদার বাড়ির পাশেই রয়েছে রাম কৃষ্ণ মিশন। ১৯১০ সালে বালিয়াটিতে শ্রী রাধিকা চরণ চৌধুরি রাম কৃষ্ণ মিশন দেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এ দেবাশ্রমে একটি উপসনালয় এবং একটি গ্রন্থাগার আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাম কৃষ্ণ মিশন কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের দশটি মিশনের মধ্যে এটি অন্যতম একটি ।
গৌরাঙ্গ মঠ
রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে রয়েছে বিখ্যাত গৌরাঙ্গ মঠ। জমিদার মনমোহন রায় চৌধুরি ১৯২৫ সালে তার সহধর্মিনী ইন্দুবালা এবং কন্যা সুনীতিবালার স্মৃতির উদ্যেশ্যে ভারতের বিখ্যাত গদাই গৌরাঙ্গ মঠের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এ শাখা মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। মঠটির ভেতরে গদাই গৌরাঙ্গ মূর্তিটি এখন আর মন্দিরে নেই। ৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক হানাদার বাহিনী পাথরের তৈরি মূর্তিটি ধ্বংস করে ফেলে।
ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়
বালিয়াটি জমিদার বাড়ির কাছেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদাালয়। বালিয়াটির অন্যতম জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়ের নামানুসারে এ স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯১৫-১৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র হরেন্দ্র কমুার রায় চৌধুরী স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। হরেন্দ্র কুমার তৎকালীন সময়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করে স্কুলটির পাকা ভবন নির্মাণ করেছিলেন।
তেওতা জমিদার বাড়ি
জেলার শিবালয় উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন জমিদার বাড়ি। বাবু হেমশংকর রায় চৌধুরী এবং জয়শংকর রায় চৌধুরী নামে দুই জমিদার ভাই সুরম্য এ বাড়িটিতে থেকে জমদিারি পরিচালনা করতেন। বর্তমানে এটি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। ভগ্নপ্রায় ৫৫ টি কক্ষ এখনও এ বাড়িটিতে অবশিষ্ট আছে।
শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি
মানিকগঞ্জ শহরে অবস্থিত ১৮৯৫-৯৬ সালে নির্মিত শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি। এ মন্দিরে শ্রী আনন্দময়ী কালী মায়ের প্রস্তর মূর্তি আছে। প্রতি বছর রথ উপলক্ষে এখানে লোকজ মেলা বসে। এছাড়া এখানে নিয়মিত ধর্মসভা, নামকীর্তন, যাত্রাপালাসহ নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
মাচাইন মসজিদ ও মাজার
সুলতানি আমলের প্রাচীন একটি স্থাপনা মাচাইন মসজিদ। এটি জেলার মাচাইন গ্রামের নামে এর নামকরণ হয়েছে। জনশ্রুতি আছে এখানে শাহ রুস্তুম নামে একজন দরবেশ বাঁশের মাচায় বসে ধ্যান মগ্ন থাকতেন। মসজিদের পাশেই এ দরবেশের মাজার অবস্থিত।
আরিচা ঘাট ও যমুনা
মানিকগঞ্জের একসময়ের ব্যস্ত জনপদ আরিচা ঘাট। ফেরি ঘাট অন্যত্র স্থানান্তরের কারণে এখন এর ব্যস্ততা অনেক কমে এসেছে। এ জায়গা থেকে যমুনার সৌন্দর্যও বেশ সুন্দর। এখানে যমুনার চরে নৌ ভ্রমণও বেশ আনন্দদায়ক।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান থেকে শুভযাত্রা, বিআরটিসি পরিবহন, গাবতলী থেকে যাত্রীসেবা, পদ্মা লাইন, নবীন বরণ, ভিলেজ লাইন, জনসেবা পরিবহন, বাবু বাজার থেকে ছালছাাবিল, শুকতারা পরিবহনে চড়ে যাওয়া যায় মানিকগঞ্জ সদরে। ভাড়া ৪০-৫০ টাকা। ঢাকা থেকে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ও এর আশপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য এসব বাসে চড়ে কালামপুর নেমে সেখান থেকে লোকাল বাসে সাঁটুরিয়া আসা যায়। মানিকগঞ্জ শহর থেকেও সাঁটুরিয়ার বাস আছে। ভাড়া ১৫ টাকা।
কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে দিনে দিনেই বেরিয়ে আসা যায় মানিকগঞ্জ। আর থাকার জন্য ভালো মানের কোন হোটেলও নেই এখানে। একান্ত জরুরি থাকতে হলে সাধারণ মানের দু’একটি হোটেলের ঠিকানা হেয়া হলো। শহরের শহীদ রফিক সড়কে হোটেল, মানিকগঞ্জ আবাসিক বোর্ডিং, ফোন- ০৬৫১-৬১৩৫৯। মানিকগঞ্জ বাস স্টেশনে হোটেল নবীন, ফোন- ০১৭১২৬১১৪৫২। এসব হোটেলের প্রতিদিনের ভাড়া এক শয্যার কক্ষ ৫০-১০০ টাকা, দ্বি-শয্যার কক্ষ ১০০-১৫০ টাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০৪, ২০১০

কুয়াকাটার কাছেই ফাতরার বন


kuyakata

আমাদের দেশে ঘুরে দেখার মতো অনেক পরিচিত জায়গা আছে। আবার এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলো কম পরিচিত হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এমনই একটি জায়গা হলো কুয়াকাটার কাছে ফাতরার বন।
কুয়াকাটা যান অনেকেই। কিন্তু এর কাছেই ফাতরার বনে অনেকেই যায় না। ওই বনে যাওয়ার জন্য অবশ্য খুব নিরাপদ ব্যবস্থা না থাকাটাও অবশ্য একটা কারণ। মাসখানেক আগে সাত বন্ধু মিলে কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে একদিন কাটিয়ে পরদিন তথ্য সংগ্রহ করে সকাল নয়টায় ফাতরার বনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে ছোট্ট একটা ট্রলারে করে শুরু হয় আমাদের সমুদ্রযাত্রা। ছিল ভয় পাওয়ার মতো যথেষ্ট উত্তাল ঢেউ। তাতেই বোঝা যায়, কেন খুব একটা পর্যটকদের আনাগোনা নেই এ পথে। এ পথে যেতে একটু রোমাঞ্চপ্রিয় হতে হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ট্রলারে টানা চলার পর চোখে পড়ল সাত-আট কিলোমিটার বিস্তৃত সারি সারি গাছ আর ঘন বনজঙ্গল। দূর থেকে মনে হলো একটা সবুজ বনের দ্বীপ। শেষে ট্রলারটি বনের কোলঘেঁষে একটা খালে ঢুকল। এই খালটিই বনের গভীরে চলে গেছে। খালের মধ্য দিয়ে কিছু দূর এগোনোর পর ট্রলারটি ছোট জেটির মতো এক জায়গায় থামল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, সুন্দরবনের কোনো খাল পার হচ্ছি। একে একে সবাই নামলাম ট্রলার থেকে। নেমেই দেখা গেল, বনের মধ্যে সাজানো-গোছানো একটি পুকুর। এর পাশে বাংলোর মতো একটা বাড়ি। আর আশপাশে দু-একজন মানুষ। জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা বললেন, এটা আমতলী ফরেস্ট রেঞ্জের বাংলো। এই বনের মাঝেমধ্যে জেলেরা মাছ ধরতে আসে। এ ছাড়া মানুষ বা কোনো বন্যপ্রাণীর আনাগোনাও নেই। চারদিকে শুধুই ঘন বন। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘন বনের মধ্যে ঘুরেফিরে বেরিয়ে আবার ট্রলারে চড়লাম। ট্রলারের চালককে খালের মধ্য দিয়ে বনের আরো গভীর যেতে বললাম। চারদিকে এত ঘন জঙ্গলে ভরা ভাবতেই পরিনি। চারদিকে নিস্তব্ধতা শুধু। মোট ঘণ্টা দুয়েক থেকে আবার ফেরার পধ ধরলাম নদী হয়ে সমুদ্রপাড় ঘেঁষে।
যাবেন কীভাবে
ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। গাবতলী থেকে বাস ছাড়ে। কুয়াকাটায় থাকার জন্য বন বিভাগের রেস্টহাউস ও বেসরকারি হোস্টেল রয়েছে। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারে করে ফাতরার বনে যেতে পারেন।
মাহবুবুল হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১১, ২০১০

ঢাকার কাছেই সুন্দর স্থাপত্য


khelaram

জজবাড়ি মোটরসাইকেল থামিয়ে মাটিতে পা রাখতেই ঝোড়ো হাওয়া যেন আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রবল বৈশাখ যেন তার দাপট দেখিয়ে গেল। এভাবেই প্রকৃতির অভ্যর্থনা পেলাম কলাকোপায়।
সামনে খেলারাম দাতা নির্মিত বিগ্রহ মন্দির। জলদস্যু থেকে দাতায় পরিণত হয়েছেন খেলারাম। তাঁর অনেক কীর্তিকলাপ ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরটি তাঁর অমর কীর্তি। আমরা মন্দিরের ভেতর ঢুকলাম।
ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইছামতীর তীরে কলাকোপা-বান্দুরার অবস্থান। ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিশাল এক ভান্ডার কলাকোপা-বান্দুরা। উনিশ শতকেও এখানে জমিদারদের বসতি ছিল। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ গ্রাম এই কলাকোপা-বান্দুরা। যা ছিল একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থস্থান। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যও চোখ জুড়ানো। যার প্রাণ ইছামতী নদী।
এখানে দেখার আছে অনেক কিছু। কোকিলপেয়ারী জমিদারবাড়ি বা জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন, যা এখন জজবাড়ি নামে খ্যাত; ব্যবসায়ী রাধানাথ সাহার বাড়ি, শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ সাহার বাড়ি, যার খ্যাতি মঠবাড়ি বা তেলিবাড়ি নামে; মধু বাবুর পাইন্নাবাড়ি, পোদ্দারবাড়ি, কালীবাড়ি এবং কলাকোপার কাছে সামসাবাদ তাঁতপল্লি, এর একটু দূরে আলানপুর তাঁতপল্লি। এ ছাড়া আছে হলিক্রস স্কুল এবং জপমালা রানির গির্জা, এর বাইরেও অনেক পুরোনো ভবন ও মঠ চোখে পড়বে কলাকোপা-বান্দুরায়।
নবাবগঞ্জ চৌরাস্তায় মহাকবি কায়কোবাদ চত্বর থেকে একটি সড়ক সোজা কলাকোপা চলে গেছে। অন্য সড়কটি একটু বামে কলাকোপা হয়ে বান্দুরার পথ ধরেছে। বামের এই পথ ধরে একটু সামনে এগোলেই একটি ভাঙা মন্দিরের দেখা মিলবে। এর পেছনে কোকিলপেয়ারী জমিদারবাড়ি। সামনের ভাঙা মন্দিরের মতোই ভগ্ন দশা তার। কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে। তার পাশেই জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন। আশির দশকের পর একটি বিচারক পরিবার এখানে বসবাস করতে শুরু করলে ব্রজ নিকেতন জজবাড়ি নাম গ্রহণ করে। জজবাড়ি এখন কলাকোপার প্রাণ। রাস্তার এক পাশে বাড়ি। অন্য পাশে দোকান, বাজার, চা—আড্ডা কত কী! তবে খুব একটা জমজমাট এখনো হয়ে ওঠেনি। জজবাড়িতে প্রচুর গাছগাছালির সমারোহ। গাছের ফাঁকে ঘুরে বেড়ায় চিত্রা হরিণ।
এ বাড়ির পাশের রাস্তাটি চলে গেছে আনসার ও ভিডিপির ক্যাম্পের দিকে। এখানে যে বাড়িতে ২৯ আনসার ব্যাটালিয়নের বসবাস, তা তেলিবাড়ি নামে খ্যাত। অনেকে একে বলে মঠবাড়ি। শোনা যায়, বাড়ির একদা মালিক বাবু লোকনাথ তেল বিক্রি করে ধনী হয়েছিলেন। তাই বাড়ির এমন নাম হয়েছে। এখানে তিন-চারটি বাড়ি আছে। ইছামতীর তীরে তেলিদের বিশাল দুটি মহল সত্যি অসাধারণ! তেলিবাড়ি থেকে সামনে ইছামতীর তীর ধরে একটু সামনে এগোলে যে ইমারতগুলো চোখে পড়বে, তার প্রথমটি পাইন্নাবাড়ি। এই বাড়ির তিন মালিকের অন্যতম মধু বাবু পান বিক্রি করে ধনী হওয়ার জন্যই বাড়িটির এমন নামকরণ।
কলাকোপা-বান্দুরায় ইছামতীর তীরে রোমান স্থাপত্যশৈলীর আরেক নিদর্শন রাধানাথ সাহার বাড়ি। বাড়িটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাড়িতে লুটপাট চলে, বাড়িটিও ভাঙচুর হয়। বাড়ির প্রধান ফটক ধরে ভেতরে ঢুকলে সামনে পড়বে বিশাল উঠোন। মাঝে জলাধার, আর তুলসী মঞ্চ। পাশেই পুজোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান। বাড়ির মালিক রাধানাথ সাহা চাল ও সুপারির ব্যবসা করতেন। ভারতের মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত তার ব্যবসার পরিধি ছিল।
এবার রাধানাথ সাহার বাড়ি পেছনে ফেলে একটু সামনে এগিয়ে যাই। সেখানেই চোখে পড়ে খেলারামের সেই বিখ্যাত বিগ্রহ মন্দিরটি। পাশেই বিশাল পুকুর। প্রচলিত আছে, মাকে বাঁচাতে খেলারাম দাতা এই পুকুরে নেমেছিলেন। আর উঠে আসেননি। এলাকাবাসীর এখনো বিশ্বাস, খেলারাম একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন, সঙ্গে নিয়ে আসবেন গঙ্গা নদীকে।
এবার বান্দুরায়
ফুলতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু সামনে এগোলেই নবাবগঞ্জের বান্দুরা গ্রাম। প্রথমেই চোখে পড়বে হলিক্রস স্কুল। আরেকটু সামনে এগোলে বিশাল মাঠ পেরিয়ে পাওয়া গেল জপমালা রানির গির্জা। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই গির্জাটি গথিক শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন। পুরো গির্জাটি হলুদ বর্ণের সুন্দর কারুকাজে ভরা। প্রার্থনা কক্ষ, সমাধিস্থলসহ সব দেখে মন ভরে যাবে। গির্জার সামনেই জপমালা দেবীর নামাঙ্কিত ফলক তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছে। ফেরার পথে সময় থাকলে তাঁতপল্লি ঘুরে আসতে পারেন। কলাকোপা-বান্দুরায় থাকার মতো ভালো হোটেল নেই। তাই সন্ধ্যার আগেই ঢাকার বাস ধরা ভালো। তবে বাড়ি ফেরার সময় বান্দুরার বাসুদেব সাহার মিষ্টান্ন ভান্ডার ঘুরে আসতে ভুল করবেন না।
কীভাবে যাবেন
কলাকোপা-বান্দুরায় দিনে এসে দিনেই ঢাকায় ফেরা যায়। এ জন্য সকালেই রওনা হওয়া দরকার। গুলিস্তান, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে সরাসরি বান্দুরার বাস সার্ভিস আছে। তবে দলবেঁধে মাইক্রোবাস নিয়ে গেলে দারুণ একটা পিকনিক করা যাবে।
ফারুখ আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৮, ২০১০