বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম। পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালী করা এই শহরে দর্শনীয় স্থানের কমতি নেই। দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরও এ শহরেই। দু’একদিন সময় নিয়ে বেরুলেই এই শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা সম্ভব। চট্টগ্রাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে কড়চার এবারের আয়োজন-
চট্টগ্রাম গেটঃ চট্টগ্রাম শহরের শুরুতেই কর্নেলহাটে রয়েছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি চট্টগ্রাম গেট। লাল ইট আর শ্বেত পাথরে তৈরি শহরেও প্রবেশের প্রধান তোরণটির মূল নাম একে খান গেট।
ফয়’স লেকঃ শহরের পাহাড়তলীতে রয়েছে ঐতিহাসিক ফয়’স লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিনশ ফুট উঁচু এ লেকে বছরের সবসময়ই কানায় কানায় জলে পূর্ণ থাকে। চারিদিকে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে এই লেকের জলরাশি। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক ১৯২৪ সালে প্রায় ৩৩৬ একর জায়গায় কৃত্রিম এ হ্রদটি খনন করা হয়। বর্তমানে ফয়’স লেকের সাথে সঙ্গতি রেখে সেখানে কনকর্ড গড়ে তুলেছে এমিউজমেন্ট পার্ক। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সেখানে এখন রয়েছে আধূনিক মানের বিভিন্ন রাইডস। ফয়’স লেকের প্রবেশমুখেই রয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়া খানা। নানা ধরণের প্রাণী রয়েছে ছোট এই চিড়িয়াখানাটিতে।
ফিরোজশাহ লেকঃ পাহাড়তলীর ফিরোজশাহ কলোনীর পাশেই রয়েছে এ লেকটি। ফয়’স লেক খননের প্রায় চার বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯২০ সালে এ লেকটিও খনন করে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে বিল্ডিংঃ শহরের সিআরবি এলাকায় পাহাড়ের উপরে রয়েছে লাল ইটে তৈরি প্রাচীন একটি সুরম্য স্থাপনা। এ অঞ্চলের রেলওয়ের প্রধান দপ্তর হিসেবে এখনও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কোর্ট বিল্ডিংঃ লালদীঘি এলাকায় পরীর পাহাড়ে আছে ঐতিহাসিক কোর্ট বিল্ডিং। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ভেঙ্গে উপরে উঠলেই দেখতে পাবেন প্রাচীন এই ভবনটি। তবে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দিন দিন হারাতে বসেছে তার জৌলুস। একে সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করে এর কোন কোন অংশ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্মাণ করা হয়েছে নতুন স্থাপনা।
লালদীঘিঃ কোর্ট বিল্ডিং এর কাছেই রয়েছে ঐতিহাসিক লালদীঘি। লালদীঘি নামের পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাস রয়েছে লোক মুখে। এই জায়গায় অনেক আগে ছিল ছোট্ট একটি জলাশয়। ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে এই জলাশয় খনন করে রূপ দেয়া হয় দীঘিতে। দীঘির পাড়ে ছিল বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুল ফোটার মৌসুমে ফুলে ফুলে লাল হয়ে যেত দীঘির পাড়। সম্ভবত সেজন্যই এর নাম হয়েছে লালদীঘি। আবার অনেকের মতে দীঘির পূর্ব দিকে তৎকালীন সময়ে যে ম্যাজিস্ট্রেট কোট এবং ট্রেজারি বিল্ডিং ছিল দুটোরই রঙ ছিল লাল। এর পাশেই ছিল জেলখানা। তার রঙও ছিল লাল। সে সময়ে জেলখানাকে বলা হতো লালঘর। একারণেই হয়তো এ দীঘির নাম হয়েছে লালদীঘি। দীঘির উত্তর পাশে আছে জমিদার রায় বাহাদুরের স্মৃতিস্তম্ভ। লালদীঘির পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান।
ওয়ার সিমেট্রিঃ শহরের গোল পাহাড়েরর মোড় থেকে একটু সামনেই আছে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওয়ার সিমেট্রি বা কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেয়া ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ভারত, মিয়ানমার, পূর্ব এবং পশ্চিম আফ্রিকা, নেদারল্যান্ড ও জাপানের সাতশ সৈনিকের সমাধি আছে এই জায়গাটিতে। দুই ঈদ ছাড়া সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা বছরই খোলা থাকে এ জায়গাটি।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরঃ শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় রয়েছে চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। জাপানের টোকিওর পরে এশিয়ায় এ ধরণের জাদুঘরের দ্বিতীয়টি হলো এটি। এখানে আছে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর জীবনচিত্র, সংস্কৃতি ও জীবনের নানান দিকের চমৎকার উপস্থাপন।
শাহ আমানত (র) মাজারঃ শহরের লাল দীঘির পূর্ব পাশে রয়েছে এ অঞ্চলের বিখ্যাত দরবেশ শাহ আমানত (র) মাজার। ধারণা করা হয় অস্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিহার থেকে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। এখানে তিনি ছোট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন এবং জজ কোর্টে পাখা টানার চাকরি করতেন।
বায়েজীদ বোস্তামী (র) মাজারঃ শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়কের পাশে নাসিরাবাদ এলাকায় রয়েছে হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (র:) মাজার। প্রতিদিন শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এ জায়গাটি।
পাথরঘাটাঃ চট্টগ্রামের প্রধান মৎস্য বন্দর। সমুদ্র থেকে মাছ ধরার ট্রলারগুলো এসে নোঙ্গর করে এখানেই। বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক মাছের পসরা দেখতে হলে যেতে হবে এ জায়গাটিতে।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতঃ শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এখানে দাঁড়িয়ে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমান জাহাগুলোকে সন্ধ্যার পরে দেখা যায় সমুদ্রের মাঝে একটি আলো ঝলমলে শহরের মতো। বন্দর রোড ধরে গেলে নতুন এয়ারপোর্ট এলাকাটিও ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এয়ারপোর্টের সামনে কর্ণফুলী নদীর দৃশ্যটাও মনোহর। শহর থেকে পতেঙ্গার বেবিটেক্সি ভাড়া ১০০ টাকা। বাস কিংবা টেম্পুতে গেলে ভাড়া লাগবে ৩০-৩৫ টাকা।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে যেতে পারেন চট্টগামে। সড়কপথে গ্রীনলাইন, সোহাগ, সৌদিয়া, এস আলম ইত্যাদি পরিবহনের বিলাসবহুল বাস চলাচল করে এ পথে। ভাড়া ৬০০-৬৭৫ টাকা। আর গ্রীন লাইন, এস আলম, সৌদিয়া, ইউনিক, শ্যামলী ইত্যাদি পরিবহনের সাধারণ মানে বাসে ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। রেল পথে ঢাকা- চট্টগ্রামের পথে মহানগর প্রভাতী ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটে, মহানগর গোধূলি ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩ টায়, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটে, তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত এগারোটায়। এছাড়া ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান, ইউনাইটেড এয়ার এবং জিএমজির বিমান চলাচল করে এ পথে।
কোথায় থাকবেনঃ চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের প্রচুর হোটেল আছে। এখানে কয়েকটি হোটেলের যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া হলো। শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় হোটেল আগ্রাবাদ, ফোন- ৭১৩৩১১-৮। হোটেল পেনিনসুলা, ফোন- ৬১৬৭২২, ৬১৯৮৫০। স্টেশন রোডে হোটেল এশিয়ান, ফোন- ২৮৫০৩৪৬-৮। পাঁচলাইশ এলাকায় রওশন বোর্ডিং, ফোন- ৬৫১৪১৬। জুবিলী রোডে হোটেল টাওয়ার ইন, ফোন- ৮৪২৬৯১-২।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৬, ২০১০
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ০৬, ২০১০
No comments:
Post a Comment