Pages

Sunday, July 29, 2012

মুন্সিগঞ্জে একদিন

munsiganj
রাজধানী থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ঐতিহাসিক জনপদ মুন্সিগঞ্জ। এর উত্তরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, পূর্বে কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা, দক্ষিণে মাদারীপুর ও শরিয়তপুর জেলা এবং পশ্চিমে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি ও শীতলক্ষা এ জেলার প্রধান নদী। এ জেলার বেশিরভাগ বেড়ানোর জায়গাই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাকেন্দ্রিক। কড়চার এবারের বেড়ানো একদিনে মুন্সিগঞ্জ ভ্রমণ।
ইদ্রাকপুর দুর্গ
মুন্সীগঞ্জ শহরের ইদ্রাকপুরে অবস্থিত ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইদ্রাকপুর দুর্গ। ইতিহাস থেকে জানা যায় মুঘল সুবাদার মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে পুরনো ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরের ইদ্রাকপুরে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা দুর্গের চেয়ে এটি আয়তনে কিছুটা ছোট। সে সময় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকা রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল এই দুর্গটি। সুরঙ্গ পথে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে এই দুর্গের সংযোগ ছিল বলে একটি জনশ্রুতি আছে। উঁচু প্রাচীর ঘেরা এই দুর্গের চারকোণে রয়েছে একটি করে গোলাকার বেস্টনী। দুর্গের ভেতর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপ করার জন্য চারদিকের দেয়ালের গায়ে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। বাংলাদেশে মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নির্দশন হিসেবে ইদ্রাকপুর দুর্গটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয় ১৯০৯ সালে।
রামপাল দীঘি
জেলার রামপালে অবস্থিত। বিক্রমপুরের রাজধানী রামপালের রাজা বল্লাল সেন জনগণের পানীয় কষ্ট দূর করার জন্য এই বিশাল দীঘিটি খনন করেন। কিংবদন্তি আছে, বল্লাল সেনের মা প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট দূর করতে তাকে একটি দীঘি খনন করার আদেশ দেন। বল্লাল সেন মাকে আশ্বাস দেন, তিনি (মা) যতদূর হেঁটে যেতে পারবেন ততটুকু জায়গা নিয়ে দীঘি খনন করে দিবেন। পরের দিন সকালে তার মা দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করেন। বল্লাল সেন দেখলেন তার মা অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে চলে গেছেন। তখন তার অসুস্থতার সংবাদ পাঠালে তিনি ফিরে আসেন। সেদিন বল্লাল সেনের মা যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততটুকু দীর্ঘ দীঘি খনন করেন বল্লাল সেন।
বল্লালবাড়ি
রামপাল দীঘির উত্তর পাশে অবস্থিত বল্লাল সেনের বাড়ি। এখানে ছিল বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ ও একটি পরিখা। বর্তমানে পরিখার চিহ্ন থাকলেও রাজপ্রাসাদটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাবা আদম শহীদ মসজিদ
জেলার রামপালের রেকাবি বাজার ইউনিয়নের কাজী কসবা গ্রামে অবস্থিত বাবা আদম শহীদ মসজিদ। এর কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপরের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান ফতেহ শাহ’র শাসনামলে, ১৪৮৩ সালে মালিক কাফুর মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১০.৩৫ মিটার ও ৩.৭৫ মিটার। এর দেয়াল প্রায় ২ মিটার পুরু। মসজিদের উপরে দুই সারিতে ছয়টি গম্বুজ আছে। মসজিদের পাশেই আছে বাবা আদমের সমাধি। জনশ্রুতি আছে, বল্লাল সেনের রাজত্বকালে বাবা আদম নামে একজন ব্যক্তি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আসেন। বল্লাল সেনের নির্দেশে বাবা আদমকে হত্যা করা হলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয়।
মীরকাদিম পুল
মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মীরকাদিম খালের ওপর নির্মিত মুঘল আমলের পুল। প্রায় ৫২.৪২ মিটার দৈর্ঘ্যের এ পুলটি বেশ কয়েকবার সংস্কারের ফলে এর পুরনো রূপ এখন আর নেই। চুন-সুরকিতে তৈরি এ পুলটির সঠিক নির্মাণকাল জানা যায়নি।
পণ্ডিতের ভিটা
সদর উপজেলার বজ্রজোগিনী ইউনিয়নের সোমপাড়ায় অবস্থিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের বসতভিটা। বর্তমানে এখানে থাই স্থাপত্য রীতিতে তৈরি একটি স্মৃতিসৌধ বর্তমান।
শ্যাম শিদ্ধির মঠ
জেলার শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর বাজারের পশ্চিম দিকে শ্যামসিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত এ মঠ। মঠটির দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের উপরের বাংলা শিলালিপি অনুযায়ী, ১৮৩৬ সালে জনৈক শম্ভুনাথ মজুমদার এটি নির্মাণ করেন। ইট নির্মিত বর্গাকোর এ মঠের দৈর্ঘ্য ৬ মিটার এবং উঁচু প্রায় ২০ মিটার।
সোনারং জোড়া মঠ
জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার সোনারং গ্রামে অবস্থিত পাশাপাশি দুটি মঠ। এর বড়টি শিবের উদ্দেশ্যে এবং ছোটটি কালীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। শিব মন্দিরটি ১৮৪৩ সালে এবং কালী মন্দিরটি ১৮৮৬ সালে নির্মিত। জানা যায়, রূপচন্দ্র নামক এক হিন্দু বণিক এর নির্মাতা।
পদ্মা রিজর্ট
জেলার লৌহজংয়ে পদ্মার চরের মনোরম একটি জায়গায় নির্মিত পদ্মা রিজর্ট। এখানে আছে কাঠের তৈরি ষোলোটি কটেজ। পদ্মা নদীর সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে থাকা-খাওয়ারও সুব্যবস্থা আছে। এখানকার রেস্তোরাঁটির খাবার মানও ভালো। কটেজে অবস্থান না করতে চাইলে শুধু জায়গাটি বেড়িয়ে আসা যায়। পদ্মা রিজর্টের আগাম বুকিং দেয়া যাবে এই নম্বরে ০১৭১৩০৩৩০৪৯।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও জলপথে মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে আসা যায়। ঢাকার গুলিস্তান ও বঙ্গভবনের দক্ষিণ পাশ থেকে নয়ন পরিবহন, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট ছাড়াও বেশ কিছু বাস মুন্সিগঞ্জ যায়। ভাড়া ৩০-৪০ টাকা। এছাড়া ঢাকার সদরঘাট থেকে ছোট ছোট কিছু লঞ্চ, চাঁদপুরগামী সব বড় লঞ্চই মুন্সিগঞ্জ কাঠপট্টি স্টেশনে থামে। ভাড়া ১৫-২০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে দিনে দিনে মুন্সিগঞ্জ ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসা সম্ভব। তাছাড়া জেলাশহরে থাকার সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের দু-একটি হোটেল হলো- হোটেল থ্রি স্টার (০১৭১৫৬৬৫৮২৯, ০১৭১৫১৭৭৭১৬) এবং হোটেল কমফোর্ট। এসব হোটেল ১৫০-৬০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে। ভ্রমণে গেলে মুন্সিগঞ্জের জায়গাগুলো দেখে সবশেষে পদ্মা রিজর্টে (০১৭১৩০৩৩০৪৯) এসে থাকলে ভালো লাগবে।
বিদ্র: বাবা আদম মসজিদের ছবিটি সংগৃহীত।
আলোকচিত্র ও লেখা: মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ১৮, ২০১০

পাহাড়, হ্রদ আর জঙ্গলের মেলবন্ধন

kaptai
বাংলাদেশে পাহাড় ও হ্রদ একসঙ্গে দেখ যাবে—এ রকম জায়গা খুব কম, এর মধ্যে রাঙামাটি একটি। আগে রাঙামটি ঘুরে দেখলেও পাহাড়ি গ্রাম বা আদিবাসীদের জীবনযাত্রার পরিচয় পাইনি। আমরা কয়েকজন বন্ধু লোকালয় থেকে একটু দূরে এমন কোনো জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম, কোথায় যাব ভাবছি। এ সময় রাঙামাটির বিলাইছড়ি থেকে এক বন্ধুর দাওয়াত পেয়ে হাতে যেন চাঁদ পেলাম।
আমরা সাত বন্ধু- দুই জোড়া দম্পতি ও তিনজন ব্যাচেলর বিলাইছড়ি রওনা দিলাম। রাতে সরাসরি কাপ্তাইয়ের বাসে রওনা দিয়ে সকাল আটটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। খবর নিয়ে জানা গেল, সাড়ে নয়টায় বিলাইছড়ির ট্রলার যাত্রা শুরু করবে, এরপর প্রতি ঘণ্টায় ট্রলার আছে। আমরা প্রথম ট্রলারেই রওনা দিয়ে ১১টার দিকে পৌঁছে গেলাম বিলাইছড়ি।
এখানে রাস্তা তেমন নেই। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া ঘুরতে গেলেও নৌকা লাগে, তবে এখন কয়েকটি সেতু হয়েছে। আমরা নৌকা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাইড হলো স্থানীয় একজন চাকমা। জানা গেল, বিলাইছড়ি উপজেলার নাম হয়েছে একই নামের ঝরনা থেকে। ছড়ি অর্থ ঝরনা আর বিলাই মানে স্থানীয় ভাষায় বাঘ। অনেক আগে প্রথম লোকবসতি শুরুর সময় এখানে ছড়ি থেকে পানি আনতে গিয়ে এক পাহাড়ি বধূ বাঘের সামনে পড়ে যায়, তখন থেকে ওই ঝরনার নাম হয়ে যায় বিলাইছড়ি এবং সংলগ্ন লোকালয় একই নামে পরিচিত হয়ে যায়। ‘তবে এখন সেই রামও নাই এবং অযোধ্যাও নাই’-এর মতো এখানে কোনো বাঘ নেই। তবে এখনো ওই ঝরনা বা ছড়ি দেখা যায়।
কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে পাহাড়, নদী, জঙ্গল ও হ্রদ নিয়ে সুন্দর একটি উপজেলা বিলাইছড়ি। অপ্রতুল যোগাযোগব্যবস্থা, তেমন প্রচার না হওয়ায় এই এলাকা এখনো লোকজনের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠেনি। গাড়ির হর্ন, কোলাহল ও নাগরিক জীবনের অপ্রিয় কিন্তু এড়ানো সম্ভব নয়,—এ ধরনের সব জিনিস এখানে এসে ভুলে থাকা যায়। অলস ঘুঘুডাকা দুপুর এখনো পাওয়া যায়। এখানে দেখার মতো প্যাগোডা, কমলা বাগান, পাহাড়, নদী, হ্রদ আছে। তবে এখানকার সহজ-সরল আদিবাসীদের সঙ্গে না ঘুরলে বা কথা না বললে ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যাবে।
বিলাইছড়িতে গেলে বাজার অবশ্যই ঘুরবেন, আদিবাসীদের নানা রকম পাহাড়ি বনজ ও অপ্রচলিত খাবার, যেমন—আদা ফুল, হলুদ ফুল, বাঁশের খোড়ল, শামুকসহ নানা রকম পাহাড়ি ঢেঁকিশাক দেখতে পাবেন। তবে সবজি দেখতে সুন্দর হলেই যে খেতে ভালো হবে, এই ধারণা নিয়ে বাজারে গেলে এবং আগে এ ধরনের খাবার না খেলে কিঞ্চিত অসুুবিধায় পড়তে হতে পারে। আমাদের সহযাত্রী মেয়েরা এই সুন্দর ফুল দেখেই কিনে ফেলল এবং খাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিল। কিন্তু একবার মুখে দেওয়ার পর মনে হলো, ফুল হাতে এবং চুলেই ভালো, রান্নাঘরে বা খাবার প্লেটে নয়।
বিলাইছড়িতে খাবারের খুব ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই নিজেরা বাজার করে হোটেল থেকে রান্না করিয়ে নেওয়াই ভালো। কাপ্তাই লেকের মাছ না খেলে ভ্রমণের মজা অন্তত বারোআনাই মাটি। আমরা মাছ ধরার চেষ্টাও চালিয়েছি ধার করা বড়শি দিয়ে, কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। কাঁকড়াও পেলাম না, শেষ পর্যন্ত বাজারই ভরসা।
বিলাইছড়িতে গেলে প্রথমেই ঘোরা উচিত ভিন্ন উপজাতিদের পাড়াগুলো। প্রতিটি উপজাতির আছে আলাদা ঐতিহ্য, আলাদা কাহিনি। এ ছাড়া কমলা বাগান, কাজুবাদামের বাগান ঘুরে দেখা যায়। তবে কাপ্তাই হূদ ও নদী অবশ্যই সময় নিয়ে দেখা উচিত। এ জন্য নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করা যায়।
এ ছাড়া আশপাশের বেশ কিছু লোকালয় আছে, যেগুলো দিনেই ঘুরে আসা যায়। কিছুটা দূরে ফারুয়া বাজার আছে, পুরো দিন হাতে থাকলে সকালে বেরিয়ে বিকেলে চলে আসা যায়। এ ছাড়া আরও কিছু নাম না জানা পাহাড় আছে। বিলাইছড়ির পাহাড় কাপ্তাই বাঁধের অংশ হিসেবে কাজ করে। তাই মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এক পাশে গভীর গিরিখাদ, অপর পাশে পানিভরা হ্রদ চোখে পড়ে। এটাও দেখা উচিত হ্রদের গভীরতা বোঝার জন্য।
এই মৌসুমে যাওয়ার আগে অবশ্যই রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টুপি নিয়ে যেতে হবে। সাঁতার কাটার ইচ্ছা থাকলে কাপড় নিতে হবে। আর টর্চলাইট নিতে ভুলবেন না। কারণ, বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকতে হবে।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
বিলাইছড়ি যাওয়ার আগে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত। বিলাইছড়ি বাজারে কাঠের দোতলা হোটেল আছে, যদিও থাকার জন্য খুব একটা ভালো বলা যাবে না। এ ছাড়া উপজেলা অফিসের একটি বাংলো আছে, যেখানে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে গেলে ভালো হয়। হোটেলের ভাড়া খুবই কম।
ঢাকা থেকে বিলাইছড়িতে যেতে হলে সরাসরি বাসে কাপ্তাই গিয়ে, সেখান থেকে ট্রলারে বিলাইছড়ি যাওয়া যায়। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। আবার সরাসরি রাঙামাটি বাসে গিয়ে, সেখান থেকে ট্রলারে দুই-আড়াই ঘণ্টা ভ্রমণ করে বিলাইছড়ি পৌঁছা যায়। ট্রলার ভাড়া ৫০ থেকে ১০০ টাকা প্রতিজনের জন্য। আর পুরো ট্রলার ভাড়া নিতে মোটামুটি ৫০০-৬০০ টাকা লাগবে। ঢাকা থেকে সরাসরি রাঙামাটি যায় এমন বাস আছে—এস আলম, ডলফিন, শান্তিসহ বেশ কিছু পরিবহন সংস্থার।
আসিফ মাহফুজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০১০

বৃষ্টিভেজা গ্রামের পথে

nodi
‘আষাঢ়-শ্রাবণ মানে না তো মন’। চলছে শ্রাবণের ধারা। রাতে বৃষ্টি, সকালেও বৃষ্টি—বিকেলে দেখলাম প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি। শত ব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবকাশ চাইছে মন।। তার মানে, মন চাইছে গ্রাম্য পরিবেশ। শহরের খুব কাছে আছে গ্রাম। গাবতলী থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার। গাবতলী আমিনবাজার পার হলেই হেমায়েতপুর, তার পরই সিংগাইর। হেমায়েতপুর গেলেই চোখে পড়বে অনেক বড় কাঁচাবাজার। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে সাভার-আরিচা। আর আমরা যাই হাতের বাঁয়ে। প্রায় এক কিলোমিটার সামনে গেলেই দুটি রাস্তা। বাঁয়ে গেলে ঋষিপাড়ার নতুন ট্যানারি অঞ্চল। আর ডানে যে রাস্তাটি গেল, সেই রাস্তা ধরেই সামনে যাই। বাঁয়ে তাকালেই চোখে পড়ে তেঁতুলঝড়া কলেজ। অনেক বড় খোলা মাঠ, খোলা আকাশ, পাশেই কৃষিজমি। দেখা যায়, কৃষক মাঠে কাজ করছেন। কলেজের পাশ দিয়েই হাতের বাঁয়ে একটু এগিয়ে গেলেই ভাষা শহীদ রফিকের নামেই ধল্লা সেতু। পার হওয়ার জন্য টোল দিয়ে চলে আসি সেতুর ওপর। উঠে দাঁড়ালাম, দখিনা হাওয়া। বহুদূর থেকে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। গা জুড়িয়ে যায়। নদীর শেষ কোথায়, দেখে বুঝতে পারলাম না। এলাকার শিক্ষক জুয়েলের কাছে জাতে চাই, এই নদীর নাম কী? নদীর নাম ধলেশ্বরী। এই নদীপথটি দিয়ে টঙ্গী থেকে সদরঘাট যাওয়া যায়। এই নদীতে একসময় নৌকাবাইচ হতো, এখন আর হয় না। সেতু থেকে দুই দিকে তাকালেই চোখে পড়ে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। সেতুর একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ উপভোগ করি সুন্দর এই প্রকৃতির খেলা। আকাশের রঙিন আলোয় চলছে ভেলা। সেতু থেকে হাতের ডানে তাকালেই দেখা যায়, একটু দূরে কাঠের বাগান। ওই গ্রামটির নাম গুচ্ছগ্রাম। একটু কষ্ট করেই ঘুরে এলাম কাঠবাগান থেকে।
এবার চলতে শুরু করলাম গ্রামে। সেতু পেরিয়ে আধা কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়ে গ্রাম। শহরের পাশে এত সুন্দর গ্রাম! অপূর্ব! রাস্তার দুধারে গাছ। প্রায় পুরো রাস্তায় ছায়া দিয়ে আছে গাছগুলো। কলাগাছ, আমগাছ, কাঁঠালগাছ, কড়ইগাছ, মেহগনিগাছ, বাঁশ ছাড়াও আরও অনেক গাছগাছালি। রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট খাল। খালে আছে কচুরিপানা। টলটলে পানি। কোথাও দেখা যায় পাট পচানোর দৃশ্য। এই খালের পাশে খুঁটিতে দেখতে পাই বিচিত্র রকমের পাখি। রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। আর দুধারে চোখে পড়ে কৃষিজমি। যেখানে চাষ করা হয়েছে পাট, ধান, সবজি, আখ, ধনচেসহ নানা ফসল। পাট খেতের দিকে তাকালে দেখা যায়, নিচের দিকে পাতা ঝরা, ফকফকা সুন্দর। খালের মধ্যে কয়েকজন মিলে পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন। আর ওপরে কচি পাতাগুলো দেখতে চা-বাগানের মতো। একটু বাতাস এলেই ঢেউ খেলে পাটের পাতা। আবার একটু সামনে একটি বাঁশের পুল পার হয়ে যাই বাড়ির মধ্যে গাঁয়ের এক মেয়ে আমাদের পানি খাওয়ায়। ভিন্ন মজা, অনেকের ছোটবেলার নস্টালজি। ছোট ছোট বাজার, সব বাজারে খাবার পেলেও একটু ভালো খাবার পাওয়া যায় জয়মণ্ডপ বাজারে। জয়মণ্ডপ থেকে ছোট্ট সেতু পার হয়ে বাঁয়ে গেলে বাটিগ্রাম। দেখা যায়, কৃষকের মেয়েটি ও কিষাণী মুড়ি ভাজছেন দুদিন ধরে। এই মুড়ি খাবে ছয় মাস। আমাদের মুড়ি খেতে দেন। আগুনের তাপে কালো হয়ে গেছে। সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি বনবাদাড় থেকে ঝুড়িতে করে লাকড়ি টোকায় নিয়ে আসছে রাতের রান্নার জন্য। রাখাল ছেলেটি গরু-বাছুর নিয়ে ফিরছে বাড়ি। পাশের আরেকটি বাড়ির মাঝখানে তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে। আর সেই গাছে বাসা বুনেছে বাবুই পাখি। বেলা শেষ হওয়ার আগেই ঘুরে আসি শহীদ রফিক স্মৃতি জাদুঘর, রামনগর রাজবাড়ী, কণ্ঠশিল্পী মমতাজের চক্ষু হাসপাতাল। বেলা শেষে আবার ফিরে আসি শহরে। আসতে হয় একই পথে, সেতু পার হয়ে। আর যে দৃশ্য চোখে পড়বে, তা হলো সবজিবাগান। কৃষক সবজি তুলে নিয়ে আসছেন বাজারে। কৃষকের হাত থেকে কেনা যায় টাটকা সবজি। আরও পাওয়া যায় ফরমালিনমুক্ত তাজা মাছ, গাছের পাকা ফল।
যাবেন কীভাবে
ভাবছেন, এত সুন্দর গ্রামে যাব কীভাবে। যদি নিজস্ব বাহন থাকে, তবে তো কথাই নেই। নিজস্ব বাহন না থাকলে আপনি যেতে পারেন সিএনজি বা ট্যাক্সিক্যাবে। আর যদি সে সুযোগও না হয়, তবে গাবতলী থেকে পাবেন বাস। গাবতলী থেকে সিংগাইর বা হরিরামপুরের বাসে উঠে পড়বেন। নামতে পারেন বানিয়ারা, জয়মণ্ডপ বা সিংগাইর। রাত্রিযাপনের কোনো সুযোগ নেই। তাই ঘোরা শেষে ফিরে আসতে হবে আপন ঠিকানায়।
খালেদ সরকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১০, ২০১০

রথ দেখা কলা বেচা

jamdani
কাল ছুটির দিন। বেড়াতে যাব, তবে ঢাকার আশপাশে। কিন্তু সব পরিচিত জায়গাই ঘুরে দেখা শেষ। এক বন্ধু জানাল, খুব ভোরে বের হলে ঢাকা শহরের কাছেই ডেমরা জামদানির হাট ঘুরে আসা যায়। শাড়ি কেনা হবে, আবার বেড়ানোও হবে। অর্থাৎ রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই। যেই কথা, সেই কাজ। ভোর ছয়টায় স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলাম।
দিনটি ছিল শুক্রবার, ভোরবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা। মোটসাইকেল যেন উড়ে চলছে। মিরপুর থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ডেমরা ঘাটে। একজন রিকশাচালকের কাছে জানতে চাইলাম, জামদানির হাট কতদূর। উত্তর মিলল, এই তো সামনে, নতুন যে সেতুটি হচ্ছে, এর বাঁ পাশ দিয়ে সামনে নদীর তীর ধরে একটু এগোলেই আহমেদ বাওয়ানী জুট মিল, পরেই বাওয়ানী উচ্চবিদ্যালয়। পাশেই হাট বসেছে শীতলক্ষ্যার তীরে। নদীতে নতুন পানি, সকালের রোদ আর তার মধ্যেই হালকা বৃষ্টি। রোদ হচ্ছে, মেঘ হচ্ছে, খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে—মনে মনে আওড়াই।
বাজারে এক পাশ করে গাড়ি পার্ক করার পরই দেখা মিলল তাঁতি মতিউরের। স্বেচ্ছায় তিনি বনে গেলেন আমাদের গাইড। তিনি জানালেন, ‘এই হাটে আসতে হয় আরও আগে। রাত তিনটা থেকে হাট শুরু আর শেষ হয় সকাল সাতটায়।’ হাটে ঢুকেই দেখি, এই সাতসকালেই মানুষের সমাগম। শাড়ি মেলে ধরে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করছেন বিক্রেতারা। রং, বুনন সম্পর্কেও নানা ধারণা দিচ্ছেন। এ হাটে কেনাবেচার পদ্ধতি বেশ মজার। কোনো দোকান নেই। তাঁতিরা হাতেই শাড়ি উঁচু করে নিয়ে ঘুরছেন। ক্রেতাদের পছন্দ হলে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছেন। সেখানে জমে যাচ্ছে আরও ক্রেতা।
ঘুরে ঘুরে শাড়ি কেনা হলো বেশ কয়েকটি। ঢাকার শপিং মলগুলোর তুলনায় দামটা কমই মনে হলো। জানা গেল হাটের পেছনের কথা। শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড়ে এই হাট উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে চলে আসছে। আগে হাটের অবস্থা অত ভালো ছিল না। এখন একটি টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে এ হাট বসে। সপ্তাহজুড়ে তাঁতিরা শাড়ি বোনেন আর শুক্রবারে তা হাটে নিয়ে আসেন। সেদিন থাকে তাঁতিদের ছুটির দিন। সেদিন আর তাঁতে বসা হয় না। তাঁতি হাটে আসেন শাড়ি বিক্রি করতে। প্রকারভেদে শাড়ির দাম দেড় হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। দাম নির্ভর করে সুতা এবং নকশার ওপর। এখানকার শাড়িগুলো ঢাকার নামীদামি দোকানগুলোয় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা হয়। ডেমরাজুড়ে কাজ করেন প্রায় দুই হাজার তাঁতি। ১০০ জনের মতো মহাজন আসেন ঢাকা থেকে। এ ছাড়াও আসেন খুচরো ক্রেতা। তাঁতি শফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিটি শাড়ি বানাতে ১০১টি যন্ত্রাংশ লাগে। তবে শাড়ি বেশ দেখেশুনে কিনতে হয় এই হাটে। দোকানে অনেক দিন পড়ে থাকে এমন শাড়িও বিক্রি করতে দেখা যায়।
শুধু শাড়ি কেনা নয়, বেড়ানোর চমৎকার জায়গা আছে আশপাশে। বাজার থেকে একটু ডানে তাকালেই চোখে পড়বে ছোট-বড় লঞ্চ, স্টিমার। পাশেই আছে নতুন সেতু। ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমুলিয়া মডেল টাউন। নদী পার হয়ে চলে যেতে পারেন ওই পাশের গ্রামে। যেখানে বসে তাঁতিরা তৈরি করেন জামদানি। নৌকায় নদী পার হতে লাগে এক টাকা। মাঝিকে পাঁচ টাকা দিলে শুধু আপনাকে নিয়েই নৌকা ছেড়ে দেবে। ঘণ্টা হিসেবেও নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে পারেন। ৩০-৪০ টাকা লাগবে তাতে। ফুরফুরে বাতাসে মনে হবে তোফা একটা ঘুম দিই। তবে গান শোনার ইচ্ছা থাকলে কিন্তু মাঝিকে অনুরোধ করে লাভ নেই। এক গাল হেসে তিনি বরং আপনাকেই পাল্টা অনুরোধ করবেন গান গাইতে।
কীভাবে যাবেন
যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে করে ডেমরা ঘাট। অথবা ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে গাড়ি বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চলে আসতে পারেন। এ জন্য রাত তিনটা থেকে চারটার মধ্যে রওনা দিলেই ভালো হয়। ডেমরা ঘাটে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জামদানি হাট দেখিয়ে দেবে। ঘাট থেকে পাঁচ-ছয় মিনিটের হাঁটা পথ। আবার যদি চিটাগাং রোড হয়ে আসতে চান তাও সহজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সরাসরি ডেমরা ঘাট।
খালেদ সরকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০১০

মেঘ বাদলে রাঙামাটি


rangamati

‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।’ একটা শব্দ বদলে বলা যায়, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর হ্রদে এল বান। কারণ, রাঙামাটিতে কোনো নদ বা নদী নেই, আছে পাহাড়ঘেরা হ্রদ। ছোট-বড় পাহাড়ের খাদে খাদে জমে থাকা সেই হ্রদের নাম কাপ্তাই হ্রদ। রাঙামাটির সৌন্দর্যের প্রাণ হলো ওই পাহাড়ঘেরা হ্রদ। বাদল দিনে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের বুকজুড়েও টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে। বান হয় না, তবে হ্রদটা জলে জলে টইটুম্বুর হয়। শীতের শীর্ণ ঝরনাগুলো স্রোতবতী হয়, ঝিরিঝিরি থেকে ঝরঝর করে পাহাড় গড়িয়ে লেকের জলে নামতে থাকে শুভলং ঝরনার জল। সে এক চমৎকার দৃশ্য, অবিশ্বাস্য উদ্দামতার এক ফেনিল আহ্বান।
শুভলং ঝরনা থেকে শুভলং বাজারে যাওয়ার পথে আছে আরও ঝরনা, আছে পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজের মাখামাখি, দিগন্ত-বিস্তৃত আকাশের ক্যানভাস, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, কিংবা জলে ডুবে থাকা মরা গাছের ডালে মাছরাঙা আর গঙ্গাফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। শীতের সেই টলটলে স্বচ্ছ জল নেই ঠিকই, তবে বাদলের ঘোলাটে জলেও পাহাড়ের ছায়া পড়ে। সে জলের ওপর দিয়ে রাঙামাটির পর্যটন ঘাট বা রিজার্ভ বাজার ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোটে করে দ্বীপ রেস্তোরাঁ পেদা টিং টিং ভায়া শুভলং ঝরনা টু শুভলং বাজার ট্রিপটা তাই রাঙামাটির এক অন্য রকমের এক ভালো লাগা ভ্রমণ। একবেলা বা পুরো দিনের জন্য এক চমৎকার ভ্রমণ প্যাকেজ।
কোনো এক ভরা বাদলে মেঘ মাথায় করে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মেখে গিয়েছিলাম এ পথে। সেই সুখস্বপ্নে কেটেছে কয়েক বর্ষা। তাই এবার আর রাঙামাটির ও পথ মাড়ালাম না, গেলাম ভিন্ন পথে। তা ছাড়া বর্ষাটা তখনো জমিয়ে শুরু হয়নি। শুভলং গিয়ে হয়তো এখনই সেই উদ্দাম যুবতী ঝরনাকে পাব না।
কালবোশেখির রুদ্ররূপ মাঝেমধ্যেই হানা দিচ্ছে রাঙামাটিতে। বাংলোয় এক দুর্দান্ত কালবোশেখির রাত পার করেছি। কড়াৎ কড়াৎ মেঘের গর্জন, বাতাস আর ঝড়ের ঝাপটা, দাঁত খিঁচিয়ে বিদ্যুতের ঝলক, দুদ্দাড় করে গাছ ভেঙে পড়া—এ সবই সইতে হয়েছে। ভোরের আলো না ফুটতেই যখন বাংলো থেকে বন্ধু পবন চাকমার মোটরবাইকে করে রওনা হলাম কলেজ বাজারের পথে, তখন দেখি পথ আগলে পড়ে আছে চাপালিশ, আকাশমণি, মিনজিরি গাছ। অগত্যা ভিন্ন পথে ঘুরে সে বাজারে যেতে হলো। উদ্দেশ্য, স্থানীয় চাকমা আদিবাসীদের ভোরবেলার কাঁচাবাজারটা দেখা। সন্ধ্যায়ই পবন জানিয়ে রেখেছিল যে খুব ভোরে না গেলে রোদ উঠতে উঠতেই বাজার ভেঙে যাবে। তাই আদিবাসীদের বাজার দেখতে হলে ভোরেই বেরোতে হবে। চাকমারা জঙ্গলের ও পাহাড়ের অনেক কিছুই খায়। পবন বলল, ‘সেগুলো তোমাদের কাছে হয়তো অখাদ্য মনে হতে পারে। কিন্তু ওসব খাদ্য বিশেষ করে গাছগাছড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে চাকমাদের সব সঞ্জীবনী ও সৌন্দর্যের শক্তি। তাই ওরা কোনো দিন কোনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা সহজে চিন্তা করে না। এ সময় তুমি বাজারে ছোট ছোট একধরনের বুটির মতো হলুদ ফুল দেখবে। আমরা বলি আগয্যা ফুল। পাহাড়ের জঙ্গলে ফোটে। বিকেলভর চাকমা মেয়েরা ওই ফুল তুলে ভোরে বেচতে আসে। ওই ফুল লেকের মাছ দিয়ে রান্না করে খাই। খুব মজা।’ দেখলাম ৬০ টাকা কেজি দরে ওই ফুল বিক্রি হচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে চাকমা মেয়েরা বিছিয়ে বসেছে অনেক দোকান। নানা ধরনের লতাপাতা, জুমের সবজি, সুগন্ধি গাছ সাবরাং, বিন্নি চাল, বাঁশের কচি কোড়ক, তারা ডাঁটা, তিতবেগুন, বয়লা শাক, ইয়েরিং শাক, কয়দা, তিদেগুলা, কচি কাঁঠাল, বাংলা কলার মোচা, এমনকি স্ট্রবেরি ফল পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। দলে দলে আদিবাসীরা সেসব কিনছে। ভোরের আলোয় রীতিমতো জমজমাট সেই বাজার।
বাজার থেকে ফিরে নাশতা সেরে এবার পথ ধরলাম কর্ণফুলী দুহিতা কাপ্তাই দেখতে। পবনের কথামতো পুরোনো পথে গেলাম না, গেলাম নতুন পথে—লেক ড্রাইভে। রাঙামাটি থেকে সম্প্রতি নতুন একটা রাস্তা হয়েছে আসামবস্তি হয়ে কাপ্তাই যাওয়ার। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য সে পথের। চড়াই-উতরাই পাহাড় ডিঙিয়ে পিচঢালা পথে গাড়ি ধীরে ধীরে ছুটে চলল কাপ্তাইয়ের পথে। এটাই এখন কাপ্তাই যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা। বাঁ দিকে বিস্তীর্ণ কাপ্তাই লেক, দূরে আবছায়া গিরিশ্রেণী, ডানে একেবারে হাতের কাছেই অনেক উঁচু-নিচু পাহাড়। সেসব পাহাড়ে খুব ফাঁকা ফাঁকা দু-একটা মাচাং ঘর, আগুনে পোড়া পাহাড়ের ঢাল, তার মানে জুম চাষের প্রস্তুতি। আকাশে দলা দলা কালো মেঘ। মেঘ ফুঁড়ে সূর্য উঠতে চাইছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে লেকের জলে। গুঁড়ো গুঁড়ো রুপো ছড়ানো যেন লেকের বুকে। পাড়ে বাঁশ আর বাংলা কলার ঝোপ, নানা রকমের অরণ্যবৃক্ষ। কোথাও বা থুরং কাঁধে আদিবাসী মেয়েরা চলেছে পাহাড়ি পথ বেয়ে, কেউ কেউ ব্যস্ত রয়েছে জুমের পোড়া মাটি পরিষ্কার ও আগর বাগানের পরিচর্যায়। কেউ বা এরই মধ্যে লেকের জলে ছোট্ট ডিঙি বেয়ে চলেছে মাছ ধরতে নয়তো দূর পাহাড় থেকে কাঠ আনতে। এসব দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছি পথ, সেতু, ছোট ছোট বাজার, নিরিবিলি নবীন অরণ্য আর মেঘমাখা ক্লান্ত আকাশ। বৃষ্টিভেজা লালমাটির সোঁদা গন্ধ এসে নাকে লাগছে। বাতাসটাও ভেজা, ঠান্ডা। কী চমৎকার এক সকাল, কী অপূর্ব এক রাঙামাটি। এসব দেখতে দেখতেই একসময় চলে এলাম কর্ণফুলীর তীরে।
বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি কন্যা কর্ণফুলী। শীতের সেই স্বচ্ছতা নেই জলে, নেই সবুজাভ রূপ। তবু ওর পাড়ে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল নরওয়ের অসলোর সেই জলপাহাড়ি ফিজোর্ডের কথা। ওদেরটা বড়, আমাদেরটা ছোট। ওদের ফিজোর্ডে পর্যটকদের নিয়ে রাজহাঁসের মতো বড় বড় জাহাজ চলে, আমাদের চলে সাম্পান। অথচ একটু পরিকল্পনা নিলে ওই ছোট্ট জায়গাটাই কত না সৌন্দর্যে ভরে উঠতে পারত। কর্ণফুলী এখন বর্ষার জল পেয়ে ঘোলাটে নেশায় ফেঁপে উঠছে। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কর্ণফুলীর দৃশ্য দেখে এসব কথাই বারবার মনে পড়তে লাগল। কাপ্তাই অরণ্যে শুনেছি বুনো হাতি আছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না, তবে বেশ কিছু বানর আর একটা সাপ দেখলাম। প্রবেশপথে অবশ্য হাতির দেখা পেলাম, সেটা সিমেন্টের তৈরি। কাছেই স্বর্গের সিঁড়ি। শুনেছি ওখান থেকে কর্ণফুলীকে আরও চমৎকার দেখায়, দেখা যায় ওপারের চা-বাগানগুলো। একদিন স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সেই স্বর্গসুখ উপভোগের ইচ্ছে তোলা রইল, আপাতত কাপ্তাই পৌঁছেই ইতি টানলাম মেঘ বাদলের রাঙামাটি দর্শনের।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি রাঙামাটি যাওয়ার বাস আছে। এ ছাড়া ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বাসে রাঙামাটি যেতে পারেন।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৮, ২০১০

নির্জনতার মায়াজালে

nirjon-khal
কক্সবাজার যাওয়া হয়েছে বেশ কবার। আর একটু দূরে যাওয়া যায় না? ঠিক করলাম কক্সবাজার ছাড়িয়ে মহেশখালী, সোনাদিয়ার দিকে চলে যাব এবার। কক্সবাজার থেকে সরাসরি সোনাদিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও মহেশখালী হয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মহেশখালীতে গিয়ে সঙ্গী পেলাম দুজনকে। একজন সেন টেং ইউন, বাড়ি মহেশখালী; আরেকজন গিয়াস উদ্দিন, বাড়ি পশ্চিম সোনাদিয়া।
পরের দিন সকালে আমরা তিনজন যাত্রা করলাম। মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত একটি বেবিট্যাক্সি নিলাম। দূরত্ব ২৫ কিমি। ঘটিভাঙা নেমে খেয়ানৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হলাম। খালে খুব বেশি পানি নেই। তবে জোয়ার শুরু হয়েছে। এখানে সোনাদিয়াকে মহেশখালীর সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য একটি সেতু বানানোর ‘উদ্যোগ’ চোখে পড়ল। সেতুটির অসম্পূর্ণ অবকাঠামো দেখে এর চেয়ে আর কোনো উৎকৃষ্ট শব্দ মনে এল না।
সোনাদিয়া যাওয়ার দুটো উপায়: হেঁটে যাওয়া অথবা জোয়ার এলে নৌকা। আমরা প্রথমটিই বেছে নিই। প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরতি যাত্রা করে। আমরা একটি নির্মাণাধীন কাঁচাপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তাটির দুই পাশ বেশ খাড়াভাবে বাঁধানো। মাটি নেওয়া হয়েছে একেবারে গোড়া থেকে। প্যারাবনের ভেতর দিয়ে তৈরি এ পথের নিম্নাংশ প্রতিদিনই জোয়ারের পানিতে ক্ষয় হয়। আমরা হাঁটছি খালি পায়ে। চারপাশ অসম্ভব নির্জন। গিয়াস উদ্দিনের হাতে এক পোঁটলা তরিতরকারি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত দূর থেকে কেন এসব বয়ে নিয়ে যাচ্ছ?’ সে জানাল, সোনাদিয়ায় কোনো হাটবাজার নেই।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা একটি উঁচু সেতুর ওপর এসে দাঁড়ালাম। এই জায়গাটির নাম মাঝের খাল। এখানে দাঁড়ালে অনেক দূর চোখ যায়। চারপাশ স্বপ্নের মতো সুন্দর। জীবনের কিছু কিছু দৃশ্য মনের ফ্রেমে গেঁথে থাকে। এ দৃশ্যটি ঠিক তেমন। সব সময় চোখে ভাসে। আমার সঙ্গে কথা বলে। খালের পানি স্বচ্ছ, টলটলে। মনে হয় এ পানি কেউ কখনো ছুঁয়ে দেখেনি; যদি তার ঘুম ভেঙে যায়! সেতুর দুই পাশের খাল কয়েকটি শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর। কোথাও কোথাও থিকথিকে পলিভূমি। এদিকটায় মাঝারি আকৃতির প্যারাবন। সাদা ও কালো বাইন, কেওড়া, হাড়গোজা, উড়িঘাস—মূলত এরাই এ বনের বাসিন্দা।
আমরা পথ থেকে নেমে ডান দিকে হাঁটতে থাকি। খানিকটা আলপথ, বাকিটা বাইনগাছের ফাঁকে ফাঁকে। তারপর লবণঘেরের উঁচু বাঁধ ধরে হাঁটা। কোথাও বসতির কোনো চিহ্ন নেই। তবে লবণচাষিদের দেখা গেল বিক্ষিপ্তভাবে। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। আমার দুই চোখ তখন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো সোনাদিয়ার গ্রাম খুঁজছিল। তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। অবশেষে আমরা গ্রামের সীমানায় এসে পৌঁছলাম। হিসাব করে দেখলাম, স্থানীয়দের হেঁটে যেতে লাগে এক ঘণ্টা, আমাদের লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। কেয়াবন ও বালির পথ মাড়িয়ে ঢুকে পড়লাম গ্রামে। হাঁটতে গেলে বালিতে পা ডুবে যায়। গিয়ে বসলাম গিয়াস উদ্দিনের ঘরে। দুপুরের খাবারটা ওখানেই সারলাম। এ ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। এখানে কোনো হোটেল তো দূরের কথা, একটা দোকানও চোখে পড়ল না।
খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। দ্বীপের পশ্চিমে শেষপ্রান্ত বেশ খোলামেলা। এখানেই শেষ বসতি। সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠে বসলে মন ভরে যায়। আছে নির্জনতা আর বিশুদ্ধ বাতাস। একদিকে সমুদ্র আর পবন ঝাউয়ের বীথি, অন্যদিকে খাল আর প্যারাবন। পড়ন্ত বিকেলে এখানে আবার ফিরে আসব, মনকে এ আশ্বাস দিয়ে উঠে পড়লাম। পথে পড়ল তরমুজখেত। সবাই মিলে তরমুজ খেলাম। এবার সাগরমুখী হলাম। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। বালুতটে ছাগলখুরীর গড়ান লতা। বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। স্থানীয় লোকেরা বলে সাগরলতা। এখানে বালির ঢিবিগুলোতে বালি আটকাতে এ লতা কাজে লাগানো হয়।
আমরা নির্জন সৈকত ধরে হাঁটছি। আরও খানিকটা সামনে গেলে সৈকতের বাঁকটা স্পস্ট হয়ে ওঠে। এবার চোখে পড়ল সামুদ্রিক কচ্ছপের হ্যাচারি। কচ্ছপ ডিম পেড়ে গেলে সেগুলো সংগ্রহ করে এখানে রাখা হয়। তারপর ডিম ফুটিয়ে ছানাগুলোকে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কাজটি করছে একটি বেসরকারি সংস্থা।
সূর্যাস্ত দেখব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু লাল গোলকটি সাগর স্পর্শ করার আগেই একটি বিশাল কালো পর্দা তাকে ঢেকে দিল।
হঠাৎ দেখি, গ্রামের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে হইহই করতে করতে সৈকতে নামল।
সন্ধ্যায় আবার গিয়ে বসলাম সেই খোলা মাঠে। আঁধার ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। সাদা পালক দুলিয়ে এক সারি বক উড়ে গেল উত্তরের খালে। একটি মৌন সন্ধ্যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল মুক্তাখচিত রাতের দিকে। মাঠের পাশেই একটি চায়ের দোকানের সন্ধান মিলল। এমন ভর সন্ধ্যায় কি চা না খেয়ে থাকা যায়! অতঃপর চা এবং একটি দীর্ঘ আড্ডা। রাতে একটি আধপাকা অফিস ঘরে থাকার ব্যবস্থা হলো। গভীর রাতে নোনা দরিয়ার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন দুপুরের আগেই গিয়াস উদ্দিন, ফরিদ উদ্দিন, কামাল পাশা ও বাবুল মিয়া আমাদের বিদায় জানাল। নৌকা চলছে তিরতির করে। দুই পাশের দৃশ্য আগের চেয়ে স্বপ্নবোনা। এই জলপথ, পলিমাটির চরা, প্যারাবন, উড়িঘাস, বকপাখি, পানকৌড়ি—সবকিছুই নির্জনতার; আমাদের কিছু নয়। আমরা ওখানে বড্ড বেমানান।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে যাবেন কক্সবাজার। কক্সবাজারের কস্তুরিঘাট থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে চেপে মহেশখালী। মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত যেতে হবে বেবিট্যাক্সিতে। সেখান থেকে ট্রলারে করে যাবেন সোনাদিয়া। আবার কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিডবোট ভাড়া করেও সোনাদিয়া যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অনেক ভাড়া গুনতে হবে। তবে সোনাদিয়ায় কোনো হোটেল কিংবা বাংলো নেই। থাকতে হবে স্থানীয়দের সঙ্গে।
মোকারম হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৫, ২০১০

নদীর বুকে এক রাত


এলিফ্যান্ট রোড থেকে রিকশা করে সদরঘাটে ঢাকা নদীবন্দর যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তেমন একটা ভিড় নেই নদীবন্দরে। টার্মিনালে ছোট-বড় অনেক লঞ্চ ভেড়ানো। ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলোই সবচেয়ে ভালো ও উন্নত মানের। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ লঞ্চে করে বাড়িতে যায়। খুব আরামদায়ক ভ্রমণ। পুরো রাত ঘুমিয়ে সকালে বরিশাল।
আমরা তখন বরিশালগামী লঞ্চ সুন্দরবন-৭-এর একটি ভিআইপি কেবিনে। আধুনিক সব ব্যবস্থাই আছে। কেবিন-বয় চা দিয়ে গেল। কাপটি নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একজনের সঙ্গে পরিচয়। উত্তরবঙ্গের মানুষ। এত বড় লঞ্চ দেখে হতবাক তিনি। বাস, ট্রাক দেখেই তিনি অভ্যস্ত। যমুনার বুকে তিনি কখনো এত বড় জলযান দেখেননি। কথা বলতে বলতে আটটা ত্রিশ বেজে গেল। হুইসেলের শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যে সুন্দরবন-৭ বরিশালের উদ্দেশে ঢাকা নদীবন্দর ত্যাগ করবে। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা রুটের নৌযানগুলো একটু তাড়াতাড়িই ছেড়ে চলে যায় গন্তব্যের দিকে।
বারান্দার টিউব লাইটের আলোটা নিভে গেল। লঞ্চ ছেড়ে দিল। ঢাকার কোলাহল আস্তে আস্তে কমে আসছিল। রাতের আঁধারে মাঝে মাঝে জ্বলছে বাতি। লঞ্চ বুড়িগঙ্গা ছেড়ে পড়ল গিয়ে ধলেশ্বরীর জলে।
রাতের খাবার এল ১০টার দিকে। রুপচাঁদা, পদ্মার ইলিশ ভাজা, ডাল চচ্চড়ি, সেই সঙ্গে কয়েক রকম ভর্তা-ভাজি। তোফা ব্যবস্থা। মুরগি ভুনাও আছে। অনেকে আবার বাসা থেকে খাবার সঙ্গে করে নিয়েও আসেন।
রাত দুটো। পদ্মা কিংবা মেঘনা নদীতে লঞ্চ। চাঁদ জেগে আছে মাথার ওপর। রাতজাগা চাঁদের অলোয় নদীর জলে অনন্য এক রুপালি আভা। গুমগুম করে জল কেটে চলে লঞ্চ। রাতে নদীর মাঝের বিশুদ্ধ বাতাসে দেহ-মন পুরোটাই জুড়িয়ে যায়। লঞ্চ ভ্রমণটা শীতের দিনে একরকম আনন্দের, আবার বর্ষাকালে আরেক ধরনের মজা। তবে বসন্ত ও বর্ষার সময় সবচেয়ে বেশি মজা। শীতের দিনে প্রকৃতি মোড়া থাকে কুয়াশার চাদরে। নদীপথে যেতে দেখা যায় নদীর জলের মধ্যে আলো জ্বলছে। আসলে এগুলো হলো ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। কখনো দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো স্টিমারের সঙ্গে। দূরে কিছুক্ষণ পরপর জ্বলে ওঠে লাল, সবুজ আলো। নৌযানগুলো কোন পথ দিয়ে যাবে, এসব বাতিঘর আলো জ্বালিয়ে তার নির্দেশনা দেয়।
বড় নদী পাড়ি দিয়ে লঞ্চ একসময় ছোট নদীতে পড়ে। তখন আর বরিশাল বেশি দূরে নয়। রাতের নীরবতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ভোরের আলো জেগে ওঠে। ভোরের পাখিরা উড়ে যায় দূরে কোথাও। শান্ত এক নদীতে চলে আসে লঞ্চটি। তার নাম হলো কীর্তনখোলা। বরিশাল এ নদীর তীরেই অবস্থিত।
তখন ভোর ছয়টা। অনেক যাত্রী তখনই নামতে শুরু করেন। কেউ আবার লঞ্চেই একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেন। ঢাকা বন্দরে লঞ্চ ভিড়লে অনেক কাকপাখি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু এখানে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন, একঝাঁক শালিক চেয়ে আছে আপনার দিকে।
লঞ্চ থেকে নেমে বরিশাল শহর ঘুরে দেখতে পারেন। ছোট্ট এক শহর। কিন্ত দেখার মতো রয়েছে কিছু স্থান। বিকেলের দিকে কীর্তনখোলা নদীর রূপটি দেখতে পারেন। অনেক পাল তোলা নৌকা, নদীর পাড়ের সবুজ আপনাকে মুগ্ধ করবে। ঘুরে আসতে পারেন কবি জীবনানন্দের বাড়ি, ব্রজমোহন কলেজ, শঙ্কর মঠ, বেলস লেক (বঙ্গবন্ধু উদ্যানসংলগ্ন), ত্রিশ গোডাউন, আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, অক্সফোর্ড মিশন চার্চ, শিশু পার্ক, পদ্মপুকুর, দুর্গা সাগর, অশ্বিনী কুমার হল, বিবির পুকুর। সবকিছু ঘুরে দেখতে দুই দিন লাগবে। অটোরিকশা ভাড়া করে নিলেই সবই হাতের কাছে। পরিচিত কেউ থাকলে অবশ্যই তার সাহায্য নেবেন।
কীভাবে যাবেন
বাস, সিএনজি, রিকশা করে সোজা চলে যাবেন গুলিস্তান বা সদরঘাট। সন্ধ্যা থেকেই অনেক লঞ্চ ছাড়ে। বরিশাল যেতে চাইলে বড় বড় নৌযান আছে। বিশেষ করে সুরভী-৭ ও ৮; সুন্দরবন-৭, পারাবত-২, ৭, ৯ ও ১১; কীর্তনখোলা, কালাম খান ইত্যাদি। অগ্রিম টিকিট বুকিংয়ের জন্য ফোন করতে পারেন। সুরভী-০১৭১২৭৭২৭৮৬, পারাবত-০১৭১১৩৪৬০৮০। স্টিমারে করে বরিশাল যেতে চাইলে চলে যান ঢাকার সদরঘাটের বাদামতলী ঘাটে। অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য বিআইডব্লিউটিএর অফিসে যোগাযোগ করুন।
সৌরভ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২২, ২০১০

এ সময়ের চাঁপাই নবাবগঞ্জ

chapai-nawabganj
উত্তরবঙ্গের আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয় এ জেলাতেই। এ জেলার সর্বত্রই মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমবাগান। এ জেলাতে আছে প্রাচীন গৌড়ের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ জেলার উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলা অবস্থিত। মহানন্দা এ জেলার প্রধান নদী। রাজধানী থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জের দূরত্ব ৩১৭ কিলোমিটার।
মহানন্দা নদী ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী। এককালের প্রমত্তা মহানন্দা এখন অনেকটা মরে গেলেও এর সৌন্দর্য কমেনি কোনো অংশে। নদীর উপরে শহরের কাছেই রয়েছে মহানন্দা সেতু। আমের সময়ে শহরের থানাঘাটে প্রতিদিন সকালবেলা দূর-দূরান্ত থেকে অনেক নৌকা ভিড় জমায়। খুব ভোরে শুরু হয়ে এ বাজার, বেলা ওঠার কিছু পরেই শেষ হয়ে যায়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দিনে দিনে নৌকার সংখ্যা কমে আসছে এ বাজারে।
কোতোয়ালি দরওয়াজা ঃ ভারত- বাংলাদেশের সিমান্তে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশপথে অবস্থিত। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়ালের অনুকরণে এর নামকরণ। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশপথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলি দিয়ে শত্রুর ওপর গুলি কিংবা তীর ছোড়া হতো বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোতোয়ালি দরওয়াজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থলবন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।
খনিয়াদিঘি মসজিদ ঃ সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আমবাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত মসজিদটি। ইটের তৈরি এ মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। প্রার্থনাকক্ষের ঠিক উপরে বিশাল আকারের এ গম্বুজটির অবস্থান। মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষের বাইরে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মূল মেহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটায় আচ্ছাদিত ছিল, যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান।
ধুনিচক মসজিদ ঃ খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মসজিদ। মসজিদটির উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল এবং ভেতরের পাথরের স্তম্ভ এখনো টিকে আছে। ছাদ এবং পূর্ব দেয়াল পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইটের তৈরি এ মসজিদটি আয়তকার। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এ মসজিদটিও পনেরো শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।
দরসবাড়ি মাদ্‌রাসা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্‌রাসার ধ্বংসাবশেষ। চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাটিতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙিনার চার পাশে ঘিরে ছিল ৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান। এ কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে পরীক্ষামূলক খনন কাজ চালায়। আর সে খননের ফলেই আবিষ্কৃত হয় মাদ্‌রাসাটির ভিত্তির। শিলালিপি থেকে জানা যায় মাদ্‌রাসাটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন। দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র। আর দরসবাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
দরসবাড়ি মসজিদ ঃ দরসবাড়ি মাদ্‌রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় মসজিদটি। এর বাইরের দিকের পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ২০.৬ মিটার। আর ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য৩০.৩ এবং প্রস্থ ১১.৭ মিটার। মসজিদটির ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংবলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশণ্ড একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ ।
তাহ্‌খানা ঃ সোনা মসজিদ স্থলবন্দর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে কিছুটা ভেতরের দিকে বিশাল একটি দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্বদক্ষিণেরটি হলো তাহখানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারো কারো মতে শাহ সুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ ঃ তাহ্‌খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটির পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চার পাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদটির পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদটি নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগদখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি ঃ মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গাজুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনী প্রাচীর । দক্ষিণ দেয়ালে আছে প্রবেশপথ। এখান থেকে পাকা পথ ধরে কিছুটা সামনেই সমাধিসৌধ। সৌধটির চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশ কিছু কবর। দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে, ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহ সুজা তখন বাংলার সুবাদার। শাহ সুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।
ছোট সোনা মসজিদ ঃ তাহ্‌খানা থেকে পূর্বপাশে প্রধান সড়ক লাগোয়া অবস্থিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সংবলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মানের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।
মসজিদটির মূল ভবনটি আয়তকার। বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঁচটি অর্ধবৃত্তকার মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি রয়েছে। এখানে কারা সমাহিত হয়েছেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিক কানিংহাম সমাধি দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে, যার একটিতে সমাহিত আছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
কানসাট বাজার ঃ সোনামসজিদ থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ফেরার পথে পড়বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল কিংবা রিকশা-ভ্যানে করে আম নিয়ে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকেন আম চাষিরা। বাজারটি ঘুরে দেখতে পারেন।
আমবাগান ঃ মহানন্দা সেতু পেরিয়ে সোনা মসজিদ স্থল বন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যে দিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু আম বাগান আর আম বাগান। পছন্দের যে কোনো বাগোনে নেমেই ঘুরে দেখতে পারেন।
কখন যাবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জে সারা বছরই বেড়ানো সম্ভব। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মে থেকে জুলাই। কারণ এ সময়ে জেলার সর্বত্র আম বাগানগুলোতে ফলে পূর্ণ থাকে।
কীভাবে যাবেন ঃ রাজধানী থেকে সরাসরি সড়কপথে চাঁপাই নবাবগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। এ পথের বাস সার্ভিস হলো- মডার্ন এন্টারপ্রাইজ (০১৭১১২২৮২১৭), ন্যাশনাল ট্রাভেলস (০১৭১১২২৮২৮৬), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০১৮১৩০৪৯৫৪৩), লতা পরিবহন, দূর-দূরান্ত পরিবহন ইত্যাদি বাসগুলো সরাসরি যায় চাঁপাই নবাবগঞ্জ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে এ পথের বাসগুলো। ভাড়া ৩০০-৩২০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাবার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
কোথায় থাকবেন ঃ চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তি মোড়ে হোটেল আল নাহিদ (০৭৮১-৫৫৭০১-৩, ০১৭১৩৩৭৬৯০২), আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), লাখেরাজ পাড়ায় হোটেল রাজ (০৭৮১-৫৬১৯৩), একই এলাকায় হোটেল রংধনু (০৭৮১-৫৫৮০৭)। এছাড়াও আরো বেশ কিছু হোটেল আছে এ শহরে। এসব হোটেলে ২০০-১০০০ টাকায় অবস্থান করা যাবে।
ফোনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা (০৭৮১-৫৫২২০), সদর হাসপাতাল (০৭৮১-৫৫২০৭), ফায়ার সার্ভিস (০৭৮১-৫৫২১২)।
আলোকচিত্র ও লেখা: মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ০১, ২০১০

রাজাদের নাটোরে

natore
নারদ নদীর তীরে অবস্থিত রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা নাটোর। এর উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া জেলা, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা, পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে রাজশাহী জেলা। আত্রাই, বড়াল, নারদ ও নন্দকুঁজা জেলার প্রধান নদী। নাটোর জেলার উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো নিয়ে কড়চার এবারের বেড়নো
রানী ভবানী রাজপ্রাসাদ
নাটোর জেলা শহরের বঙ্গজ্জল এলাকায় রয়েছে রানী ভবানী রাজপ্রাসাদ। তোরণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়বে রাজবাড়ির কামান। রাজবাড়িটির ভেতরে রয়েছে ৬টি দিঘি। আর পুরো রাজবাড়িটি বাইরের দিক থেকে লেক আকৃতির দিঘি দিয়ে ঘেরা। ভেতরে রয়েছে বড় তরফ ভবন নামে পরিচিত রানী ভবানীর রাজপ্রাসাদ। সপ্তদশ শতাব্দিতে নির্মিত সুরম্য এ ভবনটি আজও সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। জানা যায়, রাজা রামজীবন ১৭০৬-১৭১০ সালের কোনো এক সময় পুঠিয়ার রাজার নিকট থেকে প্রায় ১৮০ বিঘার একটি বিল দান হিসেবে গ্রহণ করে সেখানে এই রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলেন। রাজা রামজীবনের একমাত্র ছেলে কলিকা প্রসাদ মারা গেলে তার দত্তক ছেলের সঙ্গে রানী ভবানীর বিয়ে দেন।
উত্তরা গণভবন
জেলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি, যা উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিঘাপাতিয়া পরগনা উপহার দেন। এখানে তিনি গড়ে তোলেন বেশ কটি সুরম্য প্রাসাদ। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। পরে তার উত্তরসূরি প্রমোদনাথ রায় নতুন করে এখানে কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপাতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ সপরিবারে ভারত চলে যান। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এ রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নজরে আসে এবং এর সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এটিকে ব্যবহার করে উত্তরা গণভবন হিসেবে । প্রায় ৪৩ একর জায়গাজুড়ে চারিদিকে লেক ও প্রাচীরবেষ্টিত এ রাজবাড়িটিতে ছোট-বড় বারোটি সুরম্য ভবন আছে। ভেতরে আছে ইতালি থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান। উত্তরা গণভবনের প্রবেশ পথে চারতলা বিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির প্রবেশ দ্বার। আর এর চূড়ায় রয়েছে বিলেতের কোক অ্যান্ড টেলভি কোম্পানির শতবর্ষী প্রাচীন ঘণ্টা ঘড়ি।
চলনবিল
দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলের একটি অংশ পড়েছে নাটোরে। জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের বড় একটি অংশ। এছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়ুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের ওপর দিয়েই। শীতে এসব বিলের পানি শুকিয়ে গেলেও বর্ষায় থাকে পরিপূর্ণ। সড়কের দু’পাশে এ সময় যেদিকে চোখ যায় শুধু অথৈ জলরাশি। নিজস্ব গাড়িতে গেলে যাত্রাপথেই চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব।
চলনবিল জাদুঘর
জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে আছে চলনবিল জাদুঘর। স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ বাড়িতে ১৯৭৮ সালে গড়ে তুলেছেন বিচিত্র এ জাদুঘর। চলনবিলে প্রাপ্ত নানা নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম ছাড়াও এখানে আছে অনেক দুর্লভ সংগ্রহ। নাটোর থেকে বাসে গুরুদাসপুর উপজেলায় এসে সেখান থেকে নদী পার হয়ে রিকশায় আসা যাবে খুবজিপুর গ্রামের এ জাদুঘরে। শনিবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
হাইতি বিল
জেলাশহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে নলডাঙ্গা উপজেলায় আছে হাইতি বিল। প্রায় ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বিলটি দেশের সবচেয়ে গভীর বিল। প্রায় বারো মিটার গভীর এ বিলে সারা বছরই পানি থাকে। তবে বর্ষায় পানির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক বেশি।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলি থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ন্যাশনাল পরিবহন প্রভৃতি বাসে যাওয়া যায় নাটোর। এছাড়া রাজশাহীগামী যে কোনো বাসেই নাটোর আসা সম্ভব। ভাড়া ২৫০-৪০০টাকা।
এছাড়া ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেসে নাটোর আসা যায়। ভাড়া প্রথম শ্রেণী বাথ ৩৮০ টাকা, প্রথম শ্রেণী চেয়ার ২৬৫ টাকা, শোভন চেয়ার ১৭৫ টাকা, শোভন ১৩০ টাকা। এছাড়া খুলনা থেকে রূপসা ও সিমান্ত এক্সপ্রেসে নাটোর আসা যায়। ভাড়া শোভন চেয়ার ১৪৫ টাকা, শোভন ১২০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
নাটোর শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের চকরামপুরে হোটেল ভিআইপি (০৭৭১-৬৬০৯৭, নন এসি কক্ষ ১০০-২০০ টাকা)। মাদ্রাসা রোডে হোটেল উত্তরা (০৭৭১-৬২৫১৯, নন এসি কক্ষ ১০০ টাকা), মাদ্রাসা মোড়ে হোটেল মিল্লাত (০৭৭১-৬১০৬৫, নন এসি কক্ষ ১৮০ টাকা), কানাইখালীতে হোটেল আরপি (০৭৭১-৬২৫৭৯, নন এসি কক্ষ ১৭০ টাকা)। কানাইখালীতে হোটেল রুখসানা (০৭৭১-৬২৪৩১, নন এসি কক্ষ ১০০ টাকা)। নাটোর থেকে রাজশাহীর দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। ভালো কোনো হোটেলে থাকতে চাইলে রাজশাহী শহরে এসে থাকা যেতে পারে।
জরুরি প্রয়োজনে
জেলা সদর হাসপাতাল (০৭৭১-৬৬৯১২), সদর থানা (০৭৭১-৬৬৯১৭), ফায়ার সার্ভিস (০৭৭১-৬৬৯১১)।
আলোকচিত্র ও লেখা: মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ০৮, ২০১০

নেত্র মেলে নেত্রকোনায়

netrokona
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে ১৫৯ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ জেলা লাগোয়া জেলা নেত্রকোনা। এর উত্তরে মেঘালয়ের গারো পাহাড়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা। কংস, সোমেশ্বরী, মগরা, ধলা প্রভৃতি এ জেলার প্রধান নদী। নেত্রকোনার বিভিন্ন জয়গায় ভ্রমণ নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো।
বিরিসিরি আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি
জেলার দুর্গাপুর থানার বিরিসিরি ইউনিয়নে অবস্থিত আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার নানান নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে। এখানে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় ক্ষুদে জনগোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ
১৯৪৬-৫০ সালে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত টঙ্ক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি থেকে কিছুটা সামনে শোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছু দূর এগুলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। বর্ষা মৌসুমে শোমেশ্বরী জলে পূর্ণ থাকলেও শীত মৌসুমে নদীটি পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মনি সিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে তিন দিন ব্যাপী মনি মেলা নামে লোকজ মেলা বসে।
সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি
জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি। সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বর পঠকের বংশধররা এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাংলা ১৩০৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে জমিদার বাড়িটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের বংশধররা এটি পুনর্নির্মাণ করেন। এ জমিদার বাড়িটি চারটি অংশে বিভক্ত। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, আবু বাড়ি ও দুই আনি বাড়ি। জানা যায় ১২৮০ মতান্তরে ১৫৯৪ খ্রীস্টাব্দের কোনো এক সময়ে কামরূপ কামাখ্যা থেকে শোমেশ্বর পাঠক নামে এক ব্রাহ্মণ এ অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন। এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে থেকে যাবার পরিকল্পনা করেন। শোমেশ্বর পাঠক গারো রাজা বৈশ্যকে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্য দখল করে নেন। সে সময়ে সুসং রাজ্যের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ছিল আদিবাসী, যাদের অধিকাংশই আবার গারো। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর তার বংশধররা এ অঞ্চলে জমিদারি করে।
সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি
বিরিসিরি থেকে শোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় রানীখং গ্রাম। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি। রানীখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে।
রাশমণি স্মৃতিসৌধ
রানীখং থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাবার পথে বহেরাতলীতে আছে হাজং মাতা রাশমনি স্মৃতিসৌধ। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমণির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাশমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এখানে নির্মাণ করেছে রাশমণি স্মৃতিসৌধ।
বিজয়পুর পাহাড়
রাশমণি স্মৃতিসৌধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বিজয়পুরে আছে চীনা মাটির পাহাড়। এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ জলাধারগুলো দেখতে চমৎকার।
নেত্রকোনার হাওর
জেলার মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দায় কম বেশি ৫৬ টি হাওর ও বিল আছে। শুস্ক মৌসুমে হাওরে চাষাবাদ হলেও বর্ষা মৌসুমে পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। তখন এসব এলাকার একমাত্র বাহন হয় নৌকা। মোহনগঞ্জ শহর থেকে রিকশায় দিকলাকোনা গিয়ে এখানকার ডিঙ্গাপোতা হাওরে প্রবেশ করা যায়। এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে যাওয়া যায়। বর্ষাকালে হাওরের গ্রামগুলো একেকটি ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সরাসরি দুর্গাপুর যাবার বাস ছাড়ে। ভাড়া ১৮০-২০০ টাকা। নেত্রকোনা সদর থেকে দুর্গাপুর যাবার বাস সার্ভিস আছে। ঢাকা থেকে সরাসরি মোহনগঞ্জ যায় ঢাকার কমলাপুর থেকে বিআরটিসি ও মহাখালী থেকে নেত্র পরিবহন, রফ রফ পরিবহন, ইকোনো পরিবহনের বাস। ভাড়া ১৭০-১৮০ টাকা। ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ লোকাল ট্রেন থাকলেও তা সঠিক সময়ে চলাচল করে না।
কোথায় থাকবেন
দুর্গাপুরে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো ইয়ূথ মেন খৃষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউস। এখানকার তিনজনের কক্ষের ভাড়া ২০০ টাকা এবং একজনের কক্ষের ভাড়া ১৫০। ফোন- ০১৭৩১০৩৯৭৬৯। এছাড়া এখানে ইয়ূথ ওমেন খৃষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইডব্লিউসিএ পরিচালিত আরেকটি রেস্ট হাউস আছে। ফোন- ০১৭১২০৪২৯১৬।
এছাড়া দুর্গাপুরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। উল্লেখযোগ্য দু-একটি হলো- স্বর্ণা গেস্ট হাউস, ফোন- ০১৭২৮৪৩৮৭১২। হোটেল সুসং, ফোন: ০১৯১৪৭৯১২৫৪। হোটেল গুলশান, ফোন- ০১৭১১১৫০৮০৭। এসব হোটেলে ১০০-৫০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে। হাওর অঞ্চলে থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই হাওর ভ্রমণে গেলে মোহনগঞ্জ থানা শহরে থাকতে হবে। এ শহরে থাকার জন্য নিম্নমানের কিছু হোটেল আছে। এরকম দু-একটি হোটেল হলো স্টেশন রোডে হোটেল শাপলা, ফোন: ০১৭১২১৩৭৬৫৯। স্টেশন রোডের আরেকটি হোটেল হলো হোটেল পাঠান, ফোন- ০১৯১৬৮৮৮৪৬০। এসব হোটেলের কক্ষ ভাড়া ৫০-১০০ টাকা।
আলোকচিত্র ও লেখা: মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ০৮, ২০১০

বেড়ানো : নওগাঁ

naoga
নানা ঐতিহাসিক স্থানসমৃদ্ধ রাজশাহী বিভাগের জেলা নওগাঁ। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে নাটোর ও রাজশাহী জেলা, পূর্বে জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলা এবং পশ্চিমে নবাবগঞ্জ জেলা। আত্রাই, ছোট যমুনা, নাগর, চিরি, তুলসীগঙ্গা, পুনর্ভবা এ জেলার প্রধান নদী। কড়চার এবারের বেড়ানো নওগাঁ জেলায়।
দুবলহাটি জমিদারবাড়ি ঃ নওগাঁ সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জমিদার জগৎরাম রাজ পরিবারের আবাসস্থল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত এ জমিদার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন বেহাল দশা। ইট-সুরকিতে নির্মিত এ বাড়িতে আছে সুরম্য প্রাসাদ, দুর্গা মন্দির, রঙ্গমঞ্চ। বাড়ির মূল ভবনটিতে কমপক্ষে একশটি কক্ষ আছে। এছাড়া কারুকাজময় বারান্দা, রঙিন কাচের অলংকরণ, নানা ধরনের ভাস্কর্য এ জমিদার বাড়ির প্রধান আকর্ষণ।
বলিহার রাজবাড়ি ঃ জেলা সদর থেকে প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে বলিহার গ্রামে অবস্থিত। জানা যায় সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক জায়গির লাভ করে বলিহারের জমিদারগণ এ এলাকায় নানা স্থাপনা গড়ে তোলেন। বলিহার রাজবাড়ি এর মধ্যে অন্যতম।
কুসুম্বা মসজিদ ঃ নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা জেলার কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত দেশের উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ। এর আরেক নাম কালা পাহাড়। মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের উপরে স্থাপিত আরবি শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি তথা ১৫৫৮-৫৯ সালে নির্মিত। শেরশাহ শুরির শাসনামলের শেষ দিকে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে জনৈক সুলাইমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইটের তৈরি এ মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়াল পাথরের আস্তরণ দিয়ে আবৃত। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দুটি মিহরাব। উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে একটি উঁচু প্লাটফর্ম। ধারণা করা হয় সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এখানে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদের মিহরাবগুলো খোদাই করা পাথরের নকশায় পরিপূর্ণ। নওগাঁ থেকে বাসে আসা যায় কুসুম্বা মসজিদে।
পাহাড়পুর ঃ নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারের আরেক নাম সোমপুর বিহার। নওগাঁ শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। বহুকাল ধরে মাটি চাপা পড়ে থাকা এই বৌদ্ধ বিহারটি বেশ কয়েকবার প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল আনুমানিক ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দে এই বিহার ও মন্দির নির্মাণ করেন। যুগ যুগ ধরে এর ধ্বংসাবশেষের উপরে মাটি চাপা পড়ে বিশাল আকৃতির পাহাড়ে রূপ নেয়। আর এ কারণেই এর নাম হয় পাহাড়পুর। হিমালয়ের দক্ষিণের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। উত্তর ও দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ৯১৯ ফুট বিস্তৃত এই বিহারের চার পাশে ১৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৩ ফুট প্রস্থের ১৭৭টি কক্ষ আছে। ধারণা করা হয়, এসব কক্ষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। বিহারের উত্তর দিকে এক সারিতে ৪৫ টি এবং অপর তিন সারিতে ৪৪টি করে কক্ষ ছিল।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ভেতরের উন্মুক্ত স্থানের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির। প্রায় ২৭ বর্গ মিটার জায়গার ওপরে এ মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষের উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার। মন্দিরটি ক্রসাকৃতির এবং তিন ধাপে ক্রমহ্রাসমান ঊর্ধ্বগামী। মন্দিরের দেয়ালে রয়েছে নানা রকম পোড়ামাটির ফলকচিত্র। পাহাড়পুর খননের সময় প্রাপ্ত নানা নিদর্শন নিয়ে একটি জাদুঘর আছে পাহাড়পুর কমপ্লেক্সে ঢুকতেই। এর শীতকালীন সময়সূচি হলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। রবিবার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং অন্যান্য ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ইউনেস্কো ঘোষিত ৩২২ তম বিশ্ব ঐতিহ্য। ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য’র অন্তর্ভুক্ত হয়। নওগাঁ থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার প্রায়। শহরের বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাস যায় পাহাড়পুর। ভাড়া ৩০-৪০ টাকা।
হলুদ বিহার ঃ জেলা সদর থেকে আঠারো কিলোমিটার উত্তরে বদলগাছি থানার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাচীন প্রত্নস্থল হলুদ বিহার। স্থানীয়ভাবে দ্বীপগঞ্জ নামে পরিচিত এ গ্রামটিতে নানা প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ১৯৭৬ সালে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৪ ও ১৯৯৩ সালে এখানে খনন কাজ করে। ফলে প্রতি পাশে ৫.৮ মিটার দীর্ঘ বর্গাকার একটি ভিত্তি উন্মোচিত হয়। খননের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে হলুদ বিহারকে পাহাড়পুর ও সীতাকোট বিহারের সমসাময়িক কালের বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।
জগদ্দল মহবিহার ঃ জেলার ধামুইরহাট উপজেলায় অবস্থিত প্রত্নস্থল জগদ্দল মহাবিহার। পাল রাজাদের আমলে নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, রামপালের রাজত্বকালে (১০৭৭-১১২০) জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে এই প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়। এছাড়াও খননের সময় এখান থেকে দেড়শটিরও বেশি প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। নওগার বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাসে ধামুইরহাট উপজেলা সদরে সেখান ধেকে আবার বাস কিংবা টেম্পুতে জগদ্দল মহাবিহার আসা যায়।
ভিমের পান্টি ঃ জেলার ধামুইরহাট উপজেলায় আরেকটি প্রাচীন নিদর্শন গরুড়স্তম্ভ, স্থানীয়ভাবে যা ভিমের পান্টি নামে পরিচিত। পাল রাজা নারায়ণ পালের শাসনামলে খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এ স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। কালো পাথরে নির্মিত এ স্তম্ভটির উপরের অংশ ভাঙা, যেখানে আগে একটি গরুড় মূর্তি ছিল। জানা যায় বজ্রপাতের ফলে কোনো এক সময়ে মূর্তিটি ভেঙে যায় এবং স্তম্ভটি একদিকে কিছুটা হেলে পড়ে।
মাহিসন্তোষ ঃ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় অবস্থিত প্রত্নস্থল। জনশ্রুতি আছে এক দরবেশ মাছের পিঠে চড়ে এ স্থানে এসেছিলেন। মানুষের কাছে তিনি মাহিসওয়ার নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার নামানুসারে এ জায়গার নাম মাহিসন্তোষ। আর অন্যমতে প্রথম মহীপালের নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ হয়। এখানে একটি প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র ও একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে। এছাড়া দুটি প্রাচীন বড় পুকুর আছে এ এলাকায়।
ধীবর দিঘি ঃ জেলার পত্নীতলা উপজেলার আরেকটি দর্শনীয় জায়গা ধীবর দিঘি। এ দিঘির মাঝখানে আছে দিব্যক বিজয়স্তম্ভ। দ্বাদশ শতকে পাল শাসক দ্বিতীয় মহীপালকে যুদ্ধে পরাজিত করে কৈবত রাজা দিব্যক বিজয়ের নিদর্শন হিসেবে এ দিঘি খনন করে এর মাঝখনে বিজয়স্তম্ভটি স্থাপন করেন। পাথরের তৈরি স্তম্ভটির উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নিচের অংশ ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। নওগাঁ বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাসে পত্নীতলার নজিপুরের ধীবর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে রিকশায় ধীবর দিঘি যাওয়া যায়।
পতিসর কুঠিবাড়ি ঃ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগনার সদর কাচারি ছিল এখানে। রবীন্দ্র কাচারিবাড়িতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে কবির অনেক স্মৃতিময় নিদর্শন। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্মদিনে এখানে নানা অনুষ্ঠান এবং লোকজ মেলা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে।নওগাঁ সদর থেকে পতিসর আসা যায় বাসে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
কীভাবে যাবেন ঃ ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ঢাকার গাবতলী থেকে এ পথের বাসগুলো ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। শ্যামলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস আর পরিবহন, কেয়া পরবিহন, বাবলু পরিবহন, টি আর পরিবহন ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার নন এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া ২২০-২৪০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে নওগাঁ যায় শ্যামলি পরিবহন। ভাড়া ৪৫০ টাকা। রাজশাহী থেকেও বাসে নওগাঁ আসা যায়। ভাড়া ৭০ টাকা। এছাড়া ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, নীল সাগর এক্সপ্রেস ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস, রাজশাহী থেকে বরেন্দ্র ও তিতুমীর এক্সপ্রেস, খুলনা থেকে সীমান্ত এক্সপ্রেস ও রূপসা এক্সপ্রেসে সান্তাহার এসে সহজেই নওগাঁ আসা যায়।
কোথায় থাকবেন ঃ নওগাঁ শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এরকম কয়েকটি হোটেল হলো- শহরের সান্তাহার রোডে হোটেল অবকাশ (০৭৪১-৬২৩৫৬), সান্তাহার রোডে হোটেল ফারিয়াল (০৭৪১-৬২৭৬৫), মুক্তির মোড়ে হোটেল আগমনী (০৭৪১-৬৩৩৫১), শহরের পাড়-নওগাঁ এলাকায় হোটেল যমুনা (০৭৪১-৬২৬৭৪), পুরনো বাস স্টেশনে হোটেল সরণী (০৭৪১-৬১৬৮৫)। এসব হোটেলে ৮০-৪০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ২২, ২০১০

মধুকবির দেশে

kobi1
কবির বাড়ির পুকুর। নবগঙ্গা নদীর কাছে যাওয়ার পর মনে হলো যশোর আর বেশি দূরে নয়। মাগুরার সেই নবগঙ্গার তীরে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার যশোরের পথ ধরা। উদ্দেশ্য, যশোর রোড ও সাগরদাঁড়িতে গিয়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি দেখা। প্রকৃতিতে বিকেলের ভাবটা আসতে না আসতেই এক পশলা বৃষ্টি। যশোরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটি গেস্ট হাউসে রাতটা পার করলাম আমরা কজন। রাতে শুধু জামতলার মিষ্টি নিয়ে কিছু কথা হলো, আগে কয়েকবার জামতলা গিয়ে মিষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। ফেরার পথে এবারও ঢুঁ মারার পরিকল্পনা নিয়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে হলো।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাত্রা শুরু হলো। আটটার মধ্যে কেশবপুর চলে এসে ব্রেকফাস্ট বিরতি। নাশতা করে কেশবপুর উপজেলা পরিষদে হনুমান দেখতে গেলাম আমরা কজন। এবার কপাল ভালো। মাত্র একটি হনুমান দেখা গেল। একটু আগেই নাকি দলবল নিয়ে বাকি হনুমানগুলো জায়গা ত্যাগ করেছে। আবার আসবে খাবার দেওয়ার সময়।
কেশবপুর বাজার পার হয়ে হাইওয়ে থেকে বাঁদিকে ছোট্ট এক পিচঢালা সড়ক চলে গেছে। সড়কটির শুরুতেই আছে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রতিকৃতি। এ রাস্তা দিয়ে পথ চললেই পাওয়া যাবে সাগরদাঁড়ি, মধুকবির জন্মভিটা। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চলছে গাড়ি। দুই ধারে সবুজ ধানক্ষেত। কোথাও আছে বাবলার সারি। খেজুরগাছের মহাসমারোহ দেখতে দেখতে চলে এলাম সাগরদাঁড়ি। সাগরদাঁড়ির গায়ের কাছেই কপোতাক্ষ নদ।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা টিকিট কেটে কবির বাড়িতে ঢুকি। প্রথম দর্শনেই পুকুরের কিনারজুড়ে দেখা যাবে একটি কবিতার পঙিতমালা—‘দাঁড়াও, পথিক বর জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’ অন্যান্য পর্যটককে দেখা গেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতার লাইন পড়ছে। বাড়ির মধ্যে হালকা হলুদ ও সাদা রঙের দুটি ভবন দেখা গেল। মূল বাড়ি সংস্কার করে এ রূপ দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে প্রবেশ করার পর দেখা যাবে মোটামুটি লম্বা ধাঁচের একটি সুদৃশ্য পুকুর। বেশ বড় ও পুরোনো কিছু আমগাছ রয়েছে পুকুরের চারপাশে। ধারণা করা হয়, এ আমগাছগুলো কবির আমলেও ছিল। পুকুর পাড়ের শানবাঁধানো ঘাটে আমগাছের ছায়া অনেক দূর-দূরান্ত থেকে কবির বাড়ি দেখতে আসা মানুষ কিছুটা সময় বসে দেহ জুড়িয়ে নেয়। কবির বাড়ির দুটি ভবনের মধ্যে আছে কবির ও তাঁর পরিবারের ব্যবহূত সামগ্রী। যেমন—দা, আলনা, খাট, থালা, কাঠের সিন্দুক, কবির লিখিত পাণ্ডুলিপি, পারিবারিক ছবি, কবির বন্ধুদের ছবিসহ নানা কিছু। পুরো বাড়িটি দেখে চলে যেতে পারেন দত্ত বাড়ির নদীর ঘাটে। কপোতাক্ষ নদের তীরের যে স্থানটিতে কবি শেষবার এসেছিলেন, সেখানেও যেতে পারেন। একটি স্মৃৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাড়ি ও অন্য সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবির জন্মদিনে প্রতি বছর কবির এ পৈত্রিক বাড়িতে জন্মোৎসব ও মধুমেলা হয়।
কীভাবে যাবেন
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যেতে চাইলে ঢাকা থেকে যশোর। যশোর শহর থেকে বাসে করে কেশবপুর। সেখান থেকে সিএনজি বা মাইক্রোবাসে করে সাগরদাঁড়ি যেতে হবে।
সৌরভ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৯, ২০১০

বেলাই বিলের বুকে

bil
ঢাকার রমনা উদ্যান থেকে মোটরসাইকেলে চেপে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম বেলা ১১টায়। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যানজট কম থাকে, তবু মহাখালী পেরোতেই যানজটে পড়লাম। গাজীপুরের কাছাকাছি এসে তা চূড়ান্ত রূপ নিল। বাস ও ট্রাকচালকদের সহায়তায় রোড বিভাজকের ফাঁক গলে এধার-সেধার করে ছুটতেই সামনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে জয়দেবপুরে। সেই প্রতিরোধে শহীদ হন ১৪ বছরের বালক হুরমদ, মনু খলিফাসহ মোট চারজন। সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৯৭৩ সালে গাজীপুর চৌরাস্তায় নির্মিত হয় স্মৃতিভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী।
চেলাই থেকে বেলাই
আমাদের গন্তব্য বেলাই বিল। ঢাকার কাছে উন্নত ভূমির যেসব বিল রয়েছে, এর মধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্যে অনন্য। বিশাল বিলটির কোনো কোনো স্থানে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে, তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেক। বর্তমানে বিলটি আট বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও একসময় এটি আরও বড় ছিল। বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রামঘেরা বেলাই বিল। তবে ৪০০ বছর আগের ইতিহাসে বেলাই বিলে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চেলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল। কিংবদন্তি আছে, ভাওয়ালের সেই সময়ের ভূস্বামী ঘটেশ্বর ঘোষ ৮০টি খাল কেটে চেলাই নদীর জল নিঃশেষ করে ফেলেন। তার পরই এটি প্রকাণ্ড বিলে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ছেলেরা বিলের চারপাশে ডাঙ্গি খনন করে। এখানে ধরা হয় মাছ। আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে একফসলি জমি। তাতে চাষ হয় বোরো ধান।
বেলা দুটায় আমরা ভাওয়াল রাজবাড়ী হয়ে কানাইয়া পৌঁছাই। সেখান থেকেই চেলাই নদী ও বেলাই বিলের পথ। বাজারে মোটরবাইক থামাতেই চেলাই নদীর প্রবাহপথটি বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
ডাঙা ছেড়ে…
রমনা উদ্যান থেকে কানাইয়া বাজার। যানজটের কারণে এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রা, সন্দেহ নেই। কিন্তু পড়ন্ত বেলায় কানাইয়া বাজারের কাছে তৈরি হওয়া নতুন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই সব ক্লান্তি উধাও। শাপলা-শালুকে ভরা বেলাই বিল। মোহাবিষ্ট হয়ে কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ধ্যান ভঙ্গ হলো সঙ্গীর ডাকে। শস্য ঝাড়াইয়ের দৃশ্য দেখার জন্য তার কী উল্লাস! যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই নারীরা এ কাজটি করছেন। বাতাসে উড়ছে তুষের গুঁড়া, ধুলো। আশপাশের সব চড়ুই পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শস্যদানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর সে দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম চেলাই নদীর তীরে। কী স্বচ্ছ টলটলে পানি! খুব বেশি চওড়া নয় চেলাই নদী, তবে খুব গভীর মনে হলো। আগের সেই খরস্রোতা রূপ আর নেই।
আমরা নৌকায় চড়লাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নয়। ডিঙি নৌকা। নৌকার মাঝি আবদুস সাত্তার। তাঁর সঙ্গে আলাপ জমতে সময় লাগল না। আলাপ চলল, নৌকাও চলল তরতর করে। এভাবেই আমরা চেলাই নদীর পথ ধরে বেলাই বিলের পাড়ে বসে পড়ি। দূর থেকে ক্যামেরা তাক করতেই উঁকি দিল বেলাই বিলের বিস্তৃত জলরাশি। বিলের চারপাশে দ্বীপের মতো গ্রাম। বামচিনি মৌজা বেলাই বিলের তেমনি একটি দ্বীপগ্রাম। এর বিশেষত্ব—এক মৌজায় এক বাড়ি। গাজীপুরে এই বামচিনি মৌজা ছাড়া এমন নজির দেশের অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বিল মানেই শাপলা। বেলাই বিলে সাদা ও নীল শাপলার ছড়াছড়ি। দূরে জাল পাতার কাজে ব্যস্ত লোকজন। কেউ কেউ আবার জাল টেনে তুলে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। বিলের নতুন পানিতে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাশের কুমুনবাজারে ছুটে চলেছে। আজ যে হাটবার!
এখানকার গ্রামের মাটি লাল। লাল মাটিতে লাউ খুব ভালো জন্মে। আর রয়েছে সারি সারি তালগাছ। নৌকায় বসে দূরের তালগাছ দেখতে ভারি সুন্দর! আমরা নৌকায় চলেছি। তীরে দাঁড়িয়ে দ্বীপগ্রামবাসী আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখছে।
আমরা সাত্তার মাঝির বাড়ি গেলাম। ফেরার পথে বামচিনি মৌজার এক বাড়িতে নামতে ভুল করলাম না। এখানে ঢেঁকিতে ধান ভানছেন বাড়ির মহিলারা। বাড়ির মালিক এখন বরকত আলী। তাঁর বাড়ির উঠানে বসে চা খেতে খুব ইচ্ছে হলো। তিনি আমাদের খেতে দিলেন ডাবের পানি আর কাঁঠাল। বাড়ির চারপাশ তাল, কাঁঠাল, বাবলা, চালতা, আম আর ডাবগাছে ঘেরা। রয়েছে হিজলগাছও। এসব সৌন্দর্য ছাপিয়ে বেলাই বিল অসাধারণ! আমরা বাড়ির উঠানে বসে বেলাই বিলের রূপ দেখতে দেখতে একসময় সাত্তার মাঝির নৌকায় উঠলাম। তখন গোধূলি বেলা। গোধূলির আলোয় আলোকিত বেলাই বিলের মোহনীয় নিসর্গ দেখে মুখে আর কথা জোগাল না।
ঢাকা থেকে কানাইয়া বাজার
গুলিস্তান থেকে বাসে গাজীপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকশা বা টেম্পোতে কানাইয়া বাজার। কানাইয়া বাজার ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। দরদাম করে উঠে পড়ুন। চাইলে নিজস্ব বাহনেও যেতে পারেন দলবেঁধে। এ বর্ষায় বেলাই ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কানাইয়া বাজারে চা-বিস্কুট ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং বহনযোগ্য খাবার সঙ্গে নিন। নিজস্ব গাড়িতে টঙ্গী-পুবাইল হয়ে কানাইয়া যেতে সময় বাঁচবে, সঙ্গে যুক্ত হবে মনোরম পথসৌন্দর্য। এক দিনের জন্য দারণ বেড়ানো হবে।
ফারুখ আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৬, ২০১০

খাগড়াছড়ির বাঁকে

khagrasori
আগেও অনেকবার পাহাড়ে, এমনকি খাগড়াছড়িতেও গিয়েছি, কিন্তু বর্ষায় পাহাড়ের সজীবতা দেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকেই। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে বৃষ্টিভেজা বন, সবুজ পাহাড় আর নদী দেখার জন্য আষাঢ়ের প্রথম দিনে রওনা হয়ে গেলাম খাগড়াছড়িতে।
যে রাস্তা দিয়ে খাগড়াছড়ি যেতে হয়, সেটাও দেখার মতো। রাঙামাটি অথবা বান্দরবানের মূল শহরে যাওয়ার চেয়ে খাগড়াছড়িতে যেতে অনেক বেশি পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। এখানে যাওয়ার সময় শুধু পাহাড় নয়; ঝরনা, প্যাগোডা, জুমঘরসহ অনেক কিছুই চোখে পড়বে।
তাই রাস্তায় চোখ খোলা রেখে যেখানে ইচ্ছা থেমে ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। বৃষ্টির সময় পাহাড়গুলোকে সবুজরূপে দেখা গেল। নদী ও ঝরনাগুলোও পরিপূর্ণ প্রমত্ত রূপ নিয়ে হাজির। পথে বেশ কিছু প্যাগোডাও চোখে পড়ল। তবে দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছানোর তাড়া থাকায় বেশিক্ষণ থামা গেল না।
পাহাড়ের কোলে দূরে একটি জুমঘর অথবা দূরে পাহাড়ের চূড়ায় কর্মরত পাহাড়িদের দেখতে দেখতে চলে এলাম খাগড়াছড়িতে ঢোকার প্রবেশপথে। আলুটিলাতে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেও নামকরণের শানে নজুল জানা গেল না। তবে এটুকু জানা গেল, আলুটিলা পার্ক ও এর মধ্যে অবস্থিত গুহা প্রধান পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আলুটিলার গুহাটি পানির স্রোতের কারণে সৃষ্টি। এই গুহার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের এক পাশ থেকে আরেক পাশে হেঁটে যাওয়া যায়। এখানে গাইড আছে, মশালও কিনতে পাওয়া যায়। সুতরাং মশাল জ্বালিয়ে গাইডের সঙ্গে আমরা চলে গেলাম হাঁটু পানি ভেঙে গুহার ভেতরে। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিনিট গুহার ভেতর দিয়ে হাঁটার পর বেরিয়ে এলাম অন্যদিকে, গা ছমছম করা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ঝড়বৃষ্টির সময় গুহাতে পানির স্রোত অনেক বেশি থাকে এবং মাঝেমধ্যে পুরো গুহা পানিতে ভরে যায়। সে জন্য আকাশ দেখে ঢোকা উচিত। এখানে একটি পিকনিক স্পটও আছে, ভাড়া নিয়ে এটা ব্যবহার করা যায়।
আলুটিলা ঘুরে আমরা হোটেল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরে ঘুরতে। সৌভাগ্য যে আমাদের, চাকমা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছিলাম। তারা আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল মারমাদের একটি রেস্তোরাঁ ‘সিস্টেম ফ্যামিলি হোটেল’-এ খাওয়ার জন্য।
কখনো ভাবিনি এ রকম একটি ঘরোয়া রেস্তোরাঁ পাব খাগড়াছড়িতে এসে। অনেক বাঙালিও এখানে প্রতিদিন খাওয়ার জন্য আসেন। এখানে বাঙালি খাবারের পাশাপাশি পাহাড়ি খাবারও পাওয়া যায়। আমরা যে যার মতো খেয়ে নিলাম। যেমন, কেউ কপি বাঁশের তরকারি ও মুরগির ঝোল, আবার অনেকে আগ্রহ নিয়ে পাহাড়ি রান্না খেল। যারা ঝাল সহ্য করতে পারে, তাদের জন্য সুবিধা হবে খেতে। কারণ, পাহাড়ি রান্না ঝাল ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
এরপর চলে গেলাম চেঙ্গি নদীর তীরে সময় কাটাতে। বৃষ্টির সময় না এলে চেঙ্গির আসল রূপ দেখা যায় না। সমতলের নদী থেকে এটা পুরো আলাদা—অনেক বেশি বাঁক আর স্রোত। বৃষ্টির পরে প্রমত্তা নদীতে গাছের গুঁড়ি, বাঁশ চোখে পড়ল। তবে বৃষ্টি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই চেঙ্গি নদী আবার তার শান্ত রূপে ফিরে এল।
রাতে আমরা জামতলার একটি চাকমা হোটেলে গেলাম। এখানে আমাদের চাকমা বন্ধুদের পরামর্শে ভুনা শামুক খেলাম, চিংড়ি মাছের মতো খেতে। তবে বেশি মিল পাবেন কাঁকড়ার স্বাদের সঙ্গে।
পরদিন সকালে উঠে রওনা দিলাম ছোট মেরুং বাজারের দিকে। এখান থেকে আরও ভেতরে গিয়ে জুম চাষ দেখলাম এবং জুমঘরে বসে পাহাড়ি চাষি ও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করলাম। এখানকার বেশির ভাগ আদিবাসী সরাসরি জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। জুমে প্রথমে পাহাড় পুড়িয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে তার গর্ত করে, প্রতিটি গর্তে তিন থেকে চার-পাঁচ ধরনের বীজ বপন করা হয়। প্রধানত ধান, ভুট্টা, শসা ও বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ পাহাড়িদের মধ্যে জনপ্রিয়। জুমের মিষ্টি ভুট্টা পাহাড়িরা সেদ্ধ করে খায়, আমরাও খাওয়া শুরু করে দিলাম। পাহাড়িরা বিশেষ এক ধরনের সবজি রান্না করে ৩২ ধরনের তরকারি দিয়ে, সেই পাচন খেলাম আমরা সবাই। বিকেলে চেঙ্গি নদীতে নৌকা ভ্রমণ করে পুরো শহরের এক পাশ দিয়ে ঘুরে এলাম। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদীভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যাঁরা খাগড়াছড়িতে ঘুরতে যাবেন, তাদের প্রতি অনুরোধ রইল, একবার অবশ্যই এটি চেষ্টা করে দেখবেন।
শহরের ভেতরে অসাধারণ সুন্দর পাহাড় আর ধানখেত থাকার কথা শুনে সেদিকে গেলাম। জায়গাটার নাম নিউজিল্যান্ড পাড়া। জানা গেল, অনেক আগে এক পাহাড়ি ভদ্রলোক এই এলাকা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের মতো বাতাস;’ সেই থেকে এলাকার নাম হয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড পাড়া। আমাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে গেল, যিনি নামটা রেখেছেন, তিনি আদৌ নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন কি না। স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেল, না, তিনি কখনো নিউজিল্যান্ডে যাননি। তিনি ক্রিকেট খেলা দেখতেন, তা থেকে ধারণা করেছেন, নিউজিল্যান্ডে প্রচুর বাতাস।
এখানে নিউজিল্যান্ড ক্যাফে নামের একটি রেস্তোরাঁ আছে। তাজা ফলের শরবত এবং নানা ধরনের স্ন্যাক্স পাবেন এখানে, ফ্রেঞ্চফ্রাই থেকে শুরু করে হালিম পর্যন্ত। তবে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। চার বন্ধুর উদ্যোগে শুরু এই রেস্তোরাঁয় সামনের বার এলে ইন্টারনেটও পাওয়া যাবে বলে জানানো হলো আমাদের।
এই মৌসুমে আসার আরেকটা সুবিধা হলো তাজা, সস্তা ফল। শহরে ঢোকার ঠিক আগে প্রাকৃতিক পরিবেশে আনসারদের একটি অসাধারণ সুন্দর রেস্তোরাঁ আছে। এখানে সব সময় খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও বসে চেঙ্গি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম প্রতিদিন।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি খাগড়াছড়িতে যাওয়ার বাস আছে। এই বাসগুলো প্রথমে চট্টগ্রামে না গিয়ে সরাসরি ফেনী থেকে রামগড় হয়ে খাগড়াছড়িতে চলে যায়। শান্তি পরিবহন, সৌদিয়া ও এস আলমের সরাসরি বাস আছে। টিকিটের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। বাসে সরাসরি যেতে আট ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ট্রেন বা প্লেনে চট্টগ্রামে গিয়ে, সেখান থেকেও বাসে যাওয়া যায়, তবে ট্রেনে সময় বেশি লাগবে। থাকার জন্য পর্যটনের হোটেল আছে। খুবই সুন্দর, নদীর ঠিক পাশে। ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা, ডাবল বেড এসি রুম। এ ছাড়া শৈল সুবর্ণা আছে, ভাড়া একটু বেশি। শহরের মধ্যে আছে হোটেল জিরান। চাকমা আতিথেয়তা পেতে হলে এখানে থাকতে পারেন। এখানে এসি রুম নেই, ভাড়াও অনেক কম, ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে ডাবল রুম আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের আরও কিছু হোটেল আছে বিভিন্ন ভাড়ার মধ্যে।
আসিফ মাহফুজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০১০

হ্রদের হাতছানি

lake
কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রাম ফয়’স লেকে দিনের বেলা ঘোরাফেরা করা গেলেও রাত যাপনের ব্যবস্থা ছিল না। কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ফয়’স লেকে মনোরম রিসোর্ট তৈরি করেছে। আপনি চাইলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি রাত যাপন করতে পারেন ফয়’স লেকে। নবদম্পতিরা মধুচন্দ্রিমা সেরে আসতে পারেন। ছুটির দিনগুলো কাজে লাগিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন। শিশুদের জন্য যেমন নানা রকম রাইডের ব্যবস্থা আছে, তেমনি বড়রাও খুঁজে পাবেন পাহাড়, লেক—সব মিলে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ফয়’স লেকের প্রবেশমুখে চমৎকারভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। চারদিকে পাহাড় আর অরুণাময়ী, গোধূলি, আকাশমণি ও মন্দাকিনী, দক্ষিণী, অলকানন্দা নামের হ্রদ। পার্ক পার হয়ে হ্রদের পাড়ে যেতেই দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। এখান থেকে নৌকায় যেতে মিনিট দশেক লাগবে। তার পরই দেখা মিলবে চমৎকার রিসোর্ট। নৌকায় করে মিনিট দুয়েক যেতেই বাঁক। তারপর দুই দিকে সবুজ পাহাড়। স্বচ্ছ পানির ওপর ছুটে চলা বিভিন্ন রকমের ইঞ্জিনবোটের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের গায়ে এসে যেন আছড়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে দু-একটি করে বক এবং নাম না-জানা হরেক রকম পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো দু-একটি করে গুইসাপ পানি সাঁতরে পার হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে মনোরম পরিবেশে উন্মুক্তভাবে হরিণ বিচরণের স্থান আর সে সময় যদি আকাশ থাকে মেঘলা, কার না ইচ্ছা করবে একটা-দুইটা কবিতার লাইন আওড়াতে?
হ্রদের পানির ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। দূরে পরিপাটি কটেজ। ভ্রমণপিপাসুদের রাতযাপনের জন্য দারুণ এক স্থান! ঘুরে দেখা যাক সেখানটায়। দোতলা এই কটেজগুলো বাইরে বেশ ছিমছাম, ভেতরটা বিলাসবহুল ও মানসম্মত। আপনার প্রয়োজনের সবকিছুই চাওয়ামাত্র পেয়ে যাবেন। এভাবেই পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি কটেজ। ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে পথচলা। চাইলে বৈঠাচালিত নৌকায়ও চলাচল করতে পারেন। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্য—দুটোকেই অনায়াসে উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যাবেন ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড কনকর্ডে। এর পাশেই আছে আপনার জন্য বিলাসবহুল থাকার আবাস। নবদম্পতিদের জন্য রয়েছে হানিমুন কটেজ।
বিনোদনের জন্য থিম পার্ক ফয়’স লেক কনকর্ড, অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডে আছে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক মানের রাইডস যেমন—সার্কাস ট্রেন, ফ্যামিলি কোস্টার, ফেরিস হুইল, রেডড্রাই স্লাইড, বাম্পার কার, সার্কাস সুইং, স্পিডবোট, ওয়াটার বি। লেকের ওপর ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়ের বনাঞ্চলে ট্রাকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সুউচ্চ টাওয়ার। রিসোর্টে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকমের সুবিধা, যেমন—প্রতিদিনের সকালের নাশতা থিম পার্ক ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড রাইডসগুলো উপভোগ করার সুযোগ এবং দিনভর জলে ভিজে আনন্দ করার জন্য ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড কনকর্ড। তা ছাড়া করপোরেট গ্রাহকদের জন্য সভা, বার্ষিক সাধারণ সভা এবং বিভিন্ন রকম ইভেন্টের সুবিধা রয়েছে।
এ সম্পর্কে বিপণন ব্যবস্থাপক ফারহানুল কে চৌধুরী জানালেন, ‘আমরা সব সময়ই ফয়’স লেক রিসোর্টে অতিথিদের সেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেবার মানকে মাথায় রেখে আমাদের এগিয়ে চলা। সব বয়সের বিনোদন এবং সেবার জন্য কনকর্ড ফয়’স লেক রিসোর্ট এক অন্যতম স্থান, বিশেষ করে বর্ষা ও ভরা পূর্ণিমার দিনে।’
খরচটা হাতের নাগালেই। থিম পার্ক ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামাউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডে প্রবেশসহ সব রাইড ২০০ টাকা, ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড কনকর্ড প্রবেশসহ সব রাইড ৩৫০ টাকা। ফয়’স লেক রিসোর্টে প্রতিদিন রাত যাপন দুই হাজার ৫০০ থেকে সাত হাজার টাকা এবং রিসোর্ট বাংলোয় প্রতিদিন রাত যাপন দুই হাজার ৫০০ থেকে ছয় হাজার টাকা। যাঁরা চট্টগ্রামে এসে ফয়’স লেকে থাকতে চান, তাঁদের ঢাকা অফিস থেকে যোগাযোগ করে ফয়’স লেক রিসোর্টে বুকিং দিয়ে আসাই ভালো। ফোন: ০১৯১৩৫৩১৪৮৩, ০১৯১৩৫৩১৪৮০, (০৩১) ২৫৬৬০৮০, ফ্যাক্স: (০৩১) ৬৫৯৪০৬।
অবশ্য ইচ্ছা করলে অন্য আবাসিক হোটেলে থেকেও আপনি ফয়’স লেক ঘুরতে পারেন।
ফেরদৌস ফয়সাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০১০