অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি আমাদের সুন্দরবন। আর এ সম্পদের অন্যতম একটি হলো মধু। পশ্চিম সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী লাগোয়া লোকালয়ে এই মধু সম্পদকে কেন্দ্র করে একদল লোকের বসবাস গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে এই মধু ‘মৌয়াল’ নামের এক শ্রেণীর পেশাদারের জীবিকা নির্বাহের মূল উপাদান। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন বনে পয়লা এপ্রিল থেকে শুরু হয় মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ অভিযান। বহুকাল ধরে মৌয়ালরা নিজস্ব পদ্ধতিতে মধু নিয়ে আসেন সুন্দরবনের গহীন থেকে।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে শত শত মৌয়াল এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। সুন্দরবন ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের এ মধু সংগ্রহ দেখা হতে পারে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। গ্রীষ্মের শুরুতে এ বনের গাছে গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে। সুন্দরী, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল আরও কতশত চেনা-অচেনা গাছে ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায় বনের বাতাসে বাতাসে। মৌমাছিরা এসময় চাক বাঁধে গাছে। ফুল থেকে মধু নিয়ে চাকে জমায়।
বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভেতরে ঢুকে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। একেকবারে পনের দিনের জন্য অনুমতি পান মৌয়ালরা। পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নৌকা ছুটাতে হয় বনের উদ্দেশ্যে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার মাধ্যমে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান প্রভুর কাছে। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস এ কাপড় বিপদ-আপদ, বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছুঁড়ে মৌয়ালদের বৈঠা চালানোর অনুমতি দেন। প্রাণপণে বৈঠা বেয়ে ছুটে চলেন বনের দিকে। সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন সাধারণত একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটানোর ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছের ডালে ডালে। সবাই-ই খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। তবে চাক ভাঙার সিদ্ধান্তটি নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। সবার হাতে দা, ধামা। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন তিনি। সাধারণত তারা মৌচাকের অস্তিত্ব টের পান গাছের পাতায় মৌমাছির মল কিংবা মৌমাছির উড়াউড়ি দেখে। বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দেন একজন, একজন দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন আরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ।
প্রতিবছর মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করে থাকে বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেড। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ এ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। যে কেউ তাই কাছে থেকে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করে আবার ৪ এপ্রিল সকালে ঢাকায় পৌঁছে দেবে তারা। ৪ রাত ৩ দিনের এ ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ হবে ১৩০০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১৫০০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ :বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, ব্লক-এ, বনানী, ঢাকা। ফোন :৮৮৫৭৪২৪, ৮৮৩৪৭১৬।
আলোকচিত্রীদের জন্য
বেঙ্গলের পরিচালক রফিকুল ইসলাম নাসিম জানালেন, মধু সংগ্রহের উপরে যেসব পেশাদার ও শৌখিন আলোকচিত্রীরা ছবির গল্প তৈরি করতে চান, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকছে এবারের ভ্রমণে। মৌয়াল দলের সঙ্গে থেকে তাদের সব কর্মকাণ্ড ক্যামেরাবন্দী করার জন্য থাকবে অভিজ্ঞ মৌয়াল দল। এ ছাড়া আরও থাকবে অভিজ্ঞ গাইড।
প্রয়োজনীয় তথ্য
সুন্দরবনের এ এলাকাটিতে মানুষ খেকো বাঘের আনাগোনা বেশি। বনের কোথাও তাই নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। এ জায়গাটিতে মশা ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রবও আছে। মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নেট ঘেরা হ্যাট। এ ছাড়া শরীরের কোনো অংশই যেন খালি না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য প্যান্টের নিচের অংশ জঙ্গল বুটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ফুলহাতা টি-শার্ট পরে হাতে পরতে হবে পাতলা মোজা। সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী অঞ্চলেই মশা ও পোকা-মাকড়ের উত্পাত সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে তাই পতঙ্গ নিরোধক ক্রিম নিতে ভুলবেন না। এ ছাড়া ভ্রমণকালীন কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। বনের মধ্যে কোনোরকম পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট ফেলবেন না। বনের ভেতরে ধূমপান করবেন না।
সঙ্গে যা নেবেন
কেমোফ্লাজ ট্রাউজার, জাঙ্গল বুট, ফুল হাতা টি-শার্ট, নেট ঘেরা ক্যাপ, দুরবিন, ক্যামেরা, পর্যাপ্ত মেমোরি কার্ড, জাঙ্গল বুট, হাত মোজা, পা মোজা, রোদ টুপি বা হ্যাট, ছাতা, হেড ল্যাম্প কিংবা টর্চ, পতঙ্গ নিরোধক ক্রিম, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, মানচিত্র, জিপিএস ইত্যাদি।
মধু তথ্য
মৌয়ালরা তাদের সংগৃহীত মধু বিক্রির পসরা সাজান সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী সংলগ্ন গাবুরা গ্রামে। এখানে ২৫০-৩৫০ টাকা মূল্যে বিক্রি হয় প্রতি কেজি মধু। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু আসে খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।
লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজমামুন | শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১২, ১২ শ্রাবণ ১৪১৯
No comments:
Post a Comment