গত ২৫ বৈশাখ ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধ শততম জন্মবার্ষিকী। কবি স্মৃতিতে ধন্য অনেক জায়গাই রয়েছে এ দেশে। এ দেশে জমিদারি পরিচালনার কাজে এসে যে জায়গাগুলোতে কবি বসবাস করেছেন দিনের পর দিন, রচনা করেছিলেন তার জীবনের মহা মূল্যবান সব সাহিত্যকর্ম। চলুন ঘুরে আসি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সেইসব জায়গা থেকে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়া জেলা সদর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ি। শিলাইদহের আগে নাম ছিল খোরশেদপুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার গ্রামটি কিনে নেওয়ার আগে এখানে একটি নীলকুঠি ছিল। শেলী নামে একজন নীলকর এটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। গড়াই এবং পদ্মা নদীর মিলিত প্রবাহের ফলে গভীর একটি ‘দহ’ বা ঘূর্ণিস্রোত থেকে গ্রামটির নাম হয় শেলীদহ। পরবর্তীতে তা রূপ নেয় শিলাইদহ-তে। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইল সূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিকানা পান। জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে। কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন সময় জমিদারি দেখাশোনা করতে কবি এখানে আসতেন এবং কুঠিবাড়িতেই থাকতেন। একসময় পদ্মার ভাঙন কুঠিবাড়িকে গ্রাস করার উপক্রম হলে বাড়িটি ভেঙে নতুন কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১-১৯০১ সালে অল্প বিরতিতে কবি নিয়মিত এখানে অবস্থান করেছেন। জানা যায়, এখানে বসেই কবি রচনা করেন তার অমর সৃষ্টি সোনারতরী, চিত্রা, চৈতালী, কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য ও খেয়ার অধিকাংশ কবিতাসহ আরো অনেক উল্লেখযোগ্য রচনা। এখানে বসেই ১৯১২ সালে কবি তার নোবেল জয়ের হাতিয়ার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন।
প্রায় ১১ একর জায়গার উপরে সবুজ বৃক্ষের বাগানের ভেতরে রয়েছে দোতলা এ কুঠিবাড়ি। নিচতলা ও দোতলায় কেন্দ্রীয় হলঘরসহ এতে মোট ১৫টি কক্ষ আছে। দোতলা ভবনের উপরে পিরামিড আকৃতির ছাদ ভবনটিকে আরো দৃষ্টিনন্দন করেছে। তবে আগের রং পরিবর্তন করায় দৃষ্টিনন্দন এ কুঠিবাড়ির সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়েছে বলেই মনে করেন অভিজ্ঞজনরা।
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাদুঘর। সপ্তাহের রবি ও সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর। রবি ও সোমবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। কবির জন্মবার্ষিকী এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় শিলাইদহে।
টেগর লজ
কুষ্টিয়া শহরে কবিগুরুর আরেকটি স্মৃতিবাহী জায়গার নাম টেগর লজ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ১৮৯০-এর শেষের দিকে কুষ্টিয়া রেল স্টেশনের কাছে এ বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ভুসিমাল ও পাটের ব্যবসার জন্য কবি নিজে এ বাড়িতে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে কুষ্টিয়া এসে টেগর লজে বিশ্রাম নিয়ে তারপরে কবি যেতেন শিলাইদহে। কখনো কখনো এ যাত্রাপথে রাত্রিযাপনও করেতেন এ বাড়িতে। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত কবি এ বাড়িতে বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছেন। দীর্ঘকাল বাড়িটি অযত্নে পড়ে থাকার পর ২০০৪ সালে বাড়িটি কিনে এর সংস্কার করে কুষ্টিয়া পৌরসভা।
যাতায়াত ও থাকা :ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কপথে কুষ্টিয়া যাওয়া যায়। রেলপথে খুলনাগামী ট্রেনে ভেড়ামারা নেমে সেখান থেকে কুষ্টিয়া আসতে হবে। ঢাকার গাবতলী কল্যাণপুর থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস বি পরিবহন, কেয়া পরিবহন, রেজিনা পরিবহন প্রভৃতি বাস চলে এ পথে। ভাড়া ২৫০ টাকা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে খুলনাগামী সপ্তাহের সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭.১০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেস, শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৬.৩০ মিনিটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ভেড়ামারা যায়। ভাড়া এসি বার্থ ৭৩৬ টাকা, এসি সিট ৫০১ টাকা, প্রথম শ্রেণী বার্থ ৪৩৫ টাকা, স্নিগ্ধা শ্রেণী ৩৩৪ টাকা, শোভন চেয়ার ১৭০ টাকা, শোভন ১৪০ টাকা। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ যাওয়া যাবে রিকশা, ইজি বাইক কিংবা টেম্পুযোগে।
কুষ্টিয়া শহরে থাকার জন্য হোটেল রিভারভিউ (০৭১- ৭১৬৬০, প্রতিদিনের কক্ষ ভাড়া ৩০০-১২০০ টাকা)। ফেয়ার রেস্ট হাউস (০৭১-৬১৪৭০, প্রতিদিনের কক্ষ ভাড়া ১৫০-৬০০ টাকা )। হোটেল গোল্ডস্টার (০৭১- ৬১৬৭৫, প্রতিদিনের কক্ষ ভাড়া ১২০-৮০০ টাকা)।
শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কাছারিবাড়ি। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক জমিদারি ছিল। কবির দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকরদের একটি কুঠি নিলামে কিনে নেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে সর্বপ্রথম শাহজাদপুরে জমিদারি তত্ত্বাবধান করতে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপরে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত জমিদারির কাজে এখানে যাওয়া-আসা ও অবস্থান করেন কবি। এখানে অবস্থানকালে তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগির ফলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় রবীন্দ্রনাথের অন্য শরীকদের কাছে। তাই ১৮৯৬ সালে তিনি শাহজাদপুর ছেড়ে চলে যান। জমিদারি খাজনা আদায়ের একটি পুরনো দ্বিতল ভবন এখনো আছে, বর্তমানে যা ব্যবহূত হচ্ছে জাদুঘর হিসেবে।
যাতায়াত :ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ আসা যায় সড়ক ও রেলপথে। ঢাকার মহাখালী থেকে সৌরভ পরিবহন, এস আই এন্টারপ্রাইজ, গাবতলী থেকে ইউনিক সার্ভিস যায় সিরাজগঞ্জ। ভাড়া ১৭০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে সদানন্দপুর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জ শহর। ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, পদ্মা ও লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো সদানন্দপুর স্টেশনে থামে। ভাড়া ১১০-১২৫ টাকা। জেলা শহর থেকে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বাসে শাহজাদপুর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ কাছারিবাড়ি।
পতিসর কুঠিবাড়ি
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগনার সদর কাছারি ছিল এখানে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে এ জমিদারি ক্রয় করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন।
পতিসরের দোতলা কুঠিবাড়ি অনেকটা শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির অনুরূপ। বাড়ির সামনের প্রশস্ত খোলা মাঠ নাগর নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে অবস্থানকালে কবি নানান জনহিতকর কাজ করেন। ১৯০৫ সালে কবি পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কারের এক লক্ষ টাকাও তিনি এই ব্যাংককে দান করেন। ১৯১৩ সালে কবি পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন সময়ে এখানে অবস্থানকালে কবি রচনা করেন তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্যকর্ম। ১৯২১ সালে জমিদারি ভাগ হলে পতিসর রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে। কিন্তু নানান ব্যস্ততার কারণে পতিসরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। শেষ বারের মতো তিনি পতিসরে আসেন ১৯৩৭ সালে। এ কুঠিবাড়িতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে কবির অনেক স্মৃতিময় নিদর্শন।
যাতায়াত: ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ঢাকার গাবতলী থেকে ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। শ্যামলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস আর পরিবহন, কেয়া পরবিহন, বাবলু পরিবহন, টি আর পরিবহন ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার নন এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া ২২০-২৪০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, নীল সাগর এক্সপ্রেস ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস, রাজশাহী থেকে বরেন্দ্র ও তিতুমীর এক্সপ্রেস, খুলনা থেকে সীমান্ত এক্সপ্রেস ও রূপসা এক্সপ্রেসে সান্তাহার নেমে সেখান থেকে সহজেই নওগাঁ আসা যায়। নওগাঁ সদর থেকে পতিসর আসা যায় লোকাল বাসে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
লেখা মুস্তাফিজ মামুন | রবিবার, ২৯ জুলাই ২০১২, ১৪ শ্রাবণ ১৪১৯
আলোকচিত্র :শেখ কবিরুল হাসান ও লেখক
No comments:
Post a Comment