রাজধানী থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। দেশের যে ক’টি জঙ্গল এখনো ভালো অবস্থায় টিকে আছে, সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। নানা রকম বন্যপ্রাণী আর পাখির বিচরণ এই বনে। চলুন ঘুরে আসি রেমা-কালেঙ্গা থেকে।
রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাহাড়ি প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা। আর সুন্দরবনের পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনভূমি এটি। প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি বিস্তার লাভ করতে শুরু করে ১৯৪০ সালের দিকে। তবে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮২ সালে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এ বনের সম্প্রসারণ করা হয়। বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের চারটি বিটের (কালেঙ্গা, রেমা, ছনবাড়ী আর রশিদপুর) মধ্যে রেমা, কালেঙ্গা আর ছনবাড়ী বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গঠিত। এটি বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা নিয়ে গঠিত। এখানকার পাহাড়গুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।
রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে নানা রকম বিরল প্রাণীর বসবাস। পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। এ বনের বাসিন্দা তিন প্রজাতির বানর—কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতী’র দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এ ছাড়াও মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। এ বনের আঠারো প্রজাতির সাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগা ইত্যাদি।
রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে প্রায় ২০৫ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল ইত্যাদি।
কোথায় বেড়াবেন
রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল। প্রতিটি ট্রেইলই ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। অভয়ারণ্যের ভেতরে আছে সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের মাথাটি বনের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথা ভেদ করে আকাশে উঁকি মেরেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাই দেখা যায় বনের ভেতরের দূরদূরান্তের দৃশ্যাবলি। টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।
বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনধারাও দেখা যেতে পারে এখানে। রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরেই আছে চারটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কয়েকটি পাড়া আছে এ বনের ভেতরেই। এ ছাড়াও সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ং আদিবাসীরও বসবাস আছে এখানে।
রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরে বিজিবি ক্যাম্প ফেলে কিছুদূর সামনেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীর উত্তমের কবর। ৩ নম্বর সেক্টরের এই যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাক হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে এখানেই শহীদ হন। তার কবরের পাশের বিশাল সেগুন গাছটির শরীরে এখনো দেখা মেলে হানাদারদের সেদিনের গুলির চিহ্ন।
কীভাবে যাবেন
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে যেতে পারেন দু’ভাবে। ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে বেবি টেক্সি চেপে আসতে হবে কালেঙ্গা। বাসে শায়েস্তাগঞ্জের ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জে থামে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে ট্রেনটি। ভাড়া ১২০-৩০৫ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গার বেবি টেক্সি ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা।
কালেঙ্গা যাওয়ার অন্য পথটি ঢাকা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল, সেখান থেকে জিপে চড়ে কালেঙ্গা। শ্রীমঙ্গল থেকে গেলে জঙ্গলের ভেতরের দীর্ঘ পথটি চলতে ভালো লাগবে সবার। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি বাসে শ্রীমঙ্গলের ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৫০-৫২৬ টাকা। শ্রীমঙ্গল থেকে কালেঙ্গার জিপ ভাড়া পড়বে ২০০০-৩০০০ টাকা।
বর্ষা মৌসুমে দুটি পথই বেশ কর্দমাক্ত থাকে বলে চলতে অসুবিধা হতে পারে।
কোথায় থাকবেন
কালেঙ্গায় থাকার জন্য আছে বন বিভাগের বিশ্রামাগার। সেখানে অবস্থান করতে হলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পূর্বানুমতি লাগবে। তবে জায়গাটিতে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো নিসর্গ তরফ হিল কটেজ (০১৭৩১৯৭৭৮০৭)। এর পরিচালক আব্দুর রহমান লাশু। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমের প্রধান প্রবেশ পথের পাশে অবস্থিত এ কটেজটির ৩টি কক্ষে আট জন থাকা যায়। বেশ পরিচ্ছন্ন কটেজটির আবাসন ব্যবস্থা। বড় দুটি কক্ষের ভাড়া ১০০০ টাকা আর ছোটটির ভাড়া ৭০০ টাকা। এখানকার রান্নাও অসাধারণ। প্রতিবেলা খাবারের খরচ জনপ্রতি ২০০ টাকা আর সকালের নাস্তা ৬০ টাকা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে ভ্রমণে অবশ্যই সঙ্গে গাইড নেওয়া উচিত। ইকো গাইড আব্দুর রহিম (০১৭৪১১৪৪১৭৪) এখানকার দক্ষ গাইডদের একজন। আগে থেকে যোগাযোগ করলে সায়েস্তাগঞ্জ কিংবা শ্রীমঙ্গল থেকেই পর্যটকটের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি। পর্যটকদের এ ধরনের সেবা তরফ হিল কটেজের আব্দুর রহমান লাশুও দিয়ে থাকেন।
রেমা-কালেঙ্গায় ভ্রমণে কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি। জঙ্গলে ভ্রমণকালীন নীরবতা অবলম্বন করুন। তাতে বন্যপ্রাণী ও পাখি বেশি দেখার সুযোগ হবে। বনের মধ্যে ধূমপান করবেন না। প্লাস্টিক জাতীয় কোনো প্যাকেট, বোতল জঙ্গলে ফেলবেন না। বনের ভেতরে গান-বাজনা থেকে বিরত থাকুন। গাছপালা নষ্ট করবেন না।
সঙ্গে যা নিবেন
কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে থাকলে ভ্রমণ অনেক বেশি উপভোগ্য হয়। এ ভ্রমণে সঙ্গে অবশ্যই পতঙ্গ নিরোধক ক্রিম নেবেন। এ ছাড়াও রোদ টুপি, হেড ল্যাম্প, বাইনোকুলার কিংবা মনোকুলার, ক্যামেরা, জিপিএস, পানির বোতল ইত্যাদি সঙ্গে নিবেন।
লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা :মুস্তাফিজ মামুন
No comments:
Post a Comment