Pages

Sunday, July 29, 2012

মসজিদের শহর বাগেরহাটে


Details
প্রাচীন মসজিদের শহর দক্ষিণের বাগেরহাট সদর। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া ষাটগম্বুজ মসজিদসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ আছে এই শহরে। পবিত্র রমজান মাসে চলুন ঘুরে আসি অনুপম স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন এসব মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে। 
হযরত খানজাহান মাজার মসজিদ :হযরত খানজাহানের সমাধিসৌধের ঠিক পশ্চিম পাশেই বেশ পুরনো একটি মসজিদ। খান জাহানের সমাধিসৌধের গঠন শৈলিতে নির্মিত এ মসজিদটি তার সময়কালেই নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় হযরত খান জাহান বাগেরহাটে এসেছিলেন ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে। তিনি প্রথমে দিল্লির সুলতানের নিকট থেকে এবং বাংলার সুলতানের নিকট থেকে সুন্দরবন বনাঞ্চলের জায়গির লাভ করেন। এখানকার গভীর বন কেটে তিনি মুসলিম বসতি গড়ে তোলেন। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর খান জাহান আলীর (র) মৃত্যু হলে এ মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
জিন্দাপীর মসজিদ :হযরত খানজাহান মাজার মসজিদের পশ্চিম পাশে থেকে ঠাকুর দিঘি পাড় ধরে কিছু দূর হাঁটলেই সামনে পাওয়া যাবে ইট নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদের পাশেই রয়েছে হযরত খানজাহানের অনুসারী জিন্দাপীরের সমাধি।  
নয় গম্বুজ মসজিদ :জিন্দাপীর মসজিদের দক্ষিণ দিকে এবং ঠাকুর দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এ মসজিদ। ইটের তৈরি এ মসজিদের উপরে নয়টি গম্বুজ রয়েছে। পুরো মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির কারুকাজ খচিত।
ষাটগম্বুজ মসজিদ :ঠাকুর দিঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ। বিশাল এ মসজিদটি ইট নির্মিত। নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদটিতে মূলত একাশিটি গম্বুজ আছে। মসজিদের ছাদে ৭৭টি এবং চারকোণের টাওয়ারে ৪টি। তবে মসজিদের ভেতরের ষাটটি স্তম্ভ  থাকার কারণে এর নাম হতে পারে ষাট গম্বুজ। মসজিদের ভেতরের স্তম্ভগুলো পাথরের তৈরি। সংরক্ষণের জন্য ! স্তম্ভগুলোর পাথর চুন সুরকির প্রলেপে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে উত্তর দিকের একটি স্তম্ভ খালি রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। খান জাহানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি এটি। ধারণা করা হয় ষাট গম্বুজ মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে। 
সিংড়া মসজিদ :ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রায় তিনশ গজ দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরঘোনা গ্রামের বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি স্থাপনা সিংড়া মসজিদ। বর্গাকারে নির্মিত এ মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে ৩৯ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২৫ ফুট লম্বা। ইট নির্মিত মসজিদের প্রাচীরগুলো প্রায় ৭ ফুট প্রশস্ত। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ। প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অলংকৃত মিহরাব। তবে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুসজ্জিত। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালে একটি করে প্রবেশ পথ আছে। এ মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এর নির্মাণশৈলী বিবেচনা করে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি।  
রণবিজয়পুর মসজিদ :রণবিজয়পুর গ্রামের ষাটগম্বুজ সড়কে এ মসজিদটি অবস্থিত। ফকিরবাড়িমসজিদ নামেও একে অনেকেই জানেন। স্থাপত্যশেলীর বিচারে এটিকে হযরত খানজাহান আলীর (র.) সময়কালে (১৪৫৯ সাল) নির্মিত বলে মনে করা হয়। ইটে তৈরি এ মসজিদটি বর্গকারে নির্মিত এবং এক কক্ষবিশিষ্ট। উপরের দিকে একটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদের দেয়ালগুলো বেশ পুরু। কিবলা দেয়াল ছাড়া প্রতি দেয়ালেই তিনটি করে প্রবেশপথ আছে। পূর্ব দেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অন্য দুটি থেকে বড়। মসজিদের বাইরে চারকোনায় চারটি মিনার রয়েছে। যেগুলো খানজাহানি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ১৯৬১ সালে এটিকে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সংস্কার করা হয়। রণবিজয়পুর গ্রামের নামেই এ মসজিদের নামকরণ হয়েছে। ধারণা করা হয় এখানে কোনো এককালে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে যুদ্ধে বিজয়ের স্মরণে এ জায়গার নাম হয় রণবিজয়পুর। বাইরের দিক থেকে এর আয়তন ৫৬ বর্গ ফুট এবং ভেতরে দিকে ৩৬ বর্গফুট। মসজিদটির প্রাচীর প্রায় দশ ফুট চওড়া। রণবিজয়পুর মসজিদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ।
চুনাখোলা মসজিদ :ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধান খেতের মধ্যে এ মসজিদটি অবস্থিত। দীর্ঘকাল অযত্নে পড়ে থাকার পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদটির সংস্কার করেছে। বর্গাকৃতির এ মসজিদটি বাইরের দিকে লম্বায় প্রায় ৪০ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২৫ ফুট। দেয়ালগুলো প্রায় আট ৭ ফুট চওড়া। কেন্দ্রস্থলের উপরের দিকে রয়েছে বড় একটি গম্বুজ। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ। আর পশ্চিম দেয়ালে প্রবেশপথগুলো বরাবর রয়েছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড়। প্রতিটি মিহরাবের গায়ে রয়েছে নানারকম ফুল ও লতাপাতার কারুকাজ। মিহরাবগুলোর নিচের অংশ মাটির ভেতরে কিছুটা দেবে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে একটি করে প্রবেশ পথ। চুনাখোল মসজিদে এখনো নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 
বিবি বেগনী মসজিদ :ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটি সিংড়া মসজিদের অনুরূপ হলেও এর পশ্চিম দেয়ালে মিহরাবের সংখ্যা তিনটি। মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল জান যায় না।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সড়ক পথে বাগেরহাট যাওয়া যায়। ঢাকার সায়াদবাদ থেকে মাওয়া হয়ে বাগেরহাটের পথে যাতায়াত করে মেঘনা পরিবহন (০১৭১৭৩৮৮৫৫৩), ফাল্গুনী পরিবহন (০১৭১২২২৭৪৫১), হামিম পরিবহন (০১৭১৭৮৬৩৪৫০), আরা পরিবহন (০১৯১১৯৬১৩৬৭), পর্যটক পরিবহন (০১৭১১১৩১০৭৮), দোলা পরিবহন (০১৭৪৬০৪১৮২৮), বনফুল পরিবহন (০১৯১১২৯০৯১৪), সুন্দরবন পরিবহন (০১১৯৬০৮২৫৭৩)। ভাড়া ২৫০ টাকা। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে এ পথে যাতায়াত করে ঈগল পরিবহন (০১৭১৪৬৬২৮৮০), সৌখিন পরিবহন (০১৭১৬০৭৯৩১৭), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০১৭১১১৮৮৮৯৩), সাকুরা পরিবহন (০১৭১১০১০৪৫০)। ভাড়া ৩৫০ টাকা।  বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বাগেরহাট যায় রাজধানী পরিবহন (০১১৯৯০০১০১০), রূপসা পরিবহন (০১৭১৭৩৮৮৫৫৩), পদ্মা পরিবহন (০১৬৭১৫৮৯৩৪২), সৈকত পরিবহন (০১৭২৯৩৭৩২৮৯)। ভাড়া ৪০০ টাকা। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার প্যাডেল স্টিমারে (৯৫৫১৮৪৬, ৯৫৫৮০০০) বাগেরহাটের মংলা যাওয়া যায়। সদরঘাট থেকে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিনই ছেড়ে যায় একটি করে স্টিমার। ভাড়া প্রথম শ্রেণী জনপ্রতি ১০৩০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণী ৬২৫ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণী ১৮০ টাকা।
কোথায় থাকবেন :বাগেরহাট শহরে থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন সংলগ্ন হোটেল আল আমিন (০৪৬৮-৬৩১৬৮, ০১৭১৮৬৯২৭৩৭, এসি দ্বৈত কক্ষ ১০০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ১০০-৪০০ টাকা)। কর্মকার পট্টিতে হোটেল মোহনা (০৪৬৮-৬৩০৭৫, ০১৭২২৮৫৮৩১৩, ১০০-৪০০ টাকায় নন এসি কক্ষ)।

 আলোকচিত্র ও লেখা :মুস্তাফিজ মামুন

No comments:

Post a Comment