Pages

Saturday, July 28, 2012

বেড়ানো : শীতে কুয়াকাটা


Details
বাংলাদেশের দক্ষিণে মনোরম একটি সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। একই জায়গা থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায় বলে দেশের অন্যান্য সমুদ্রসৈকত থেকে এটি ভিন্নতর। কুয়াকাটার নামকরণ নিয়ে রয়েছে মজার ইতিহাস। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন আরাকান ছেড়ে নৌকাযোগে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। চলতে চলতে তারা বঙ্গোপসাগরের তীরের রাঙ্গবালি দ্বীপ খুঁজে পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করে। সাগরের লোনা পানি ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মিষ্টি পানির জন্য তারা এখানে একটি কূপ খনন  করে এবং এ স্থানের নাম দেয় কুয়াকাটা।
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত :কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতটি বেশ পরিচ্ছন। প্রায় আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ এবং তিন কিলোমিটার প্রশ্বস্ত এ সৈকতটি প্রতিবার জোয়ারে ধুয়ে সাফ হয়ে থাকে। পুরো সৈকতের কোল ঘেঁষেই দেখা যায় কমবেশি নারিকেল বিথী। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এ জায়গা থেকেই সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। তবে সেটা সৈকতের দুই প্রান্ত থেকে। ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় সৈকতের গঙ্গামতির বাঁক থেকে আর সূর্যাস্ত দেখা যায় পশ্চিম সৈকত থেকে। সমুদ্রসৈকতের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে গঙ্গামতির খাল। এর পরেই গঙ্গামতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে আছে জেলে পল্লী। মাছের শুঁটকি তৈরির বিশাল একটি এলাকাও আছে এখানে। এ ছাড়া পুরো সৈকতজুড়েই সারা বছর দেখা মিলবে মাছ শিকারিদের বিভিন্ন কৌশলে মাছ ধরার দৃশ্য। কুয়াকাটার সৈকতে বেড়ানোর জন্য রয়েছে মটর সাইকেলের ব্যবস্থা। একটি সাইকেলে দুইজন ভ্রমণ করা যায়।
কুয়াকাটার কুয়া :কুয়াকাটা নামকরণের উত্স প্রাচীন সেই কুয়াটি এখনো আছে। তবে বিভিন্ন সময় সংস্কারের (?) নামে এর মূল সৌন্দর্য এবং প্রাচীন আদল বিনষ্ট করা হয়ে গেছে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কাছেই রাখাইন আদিবাসীদের বাসস্থল কেরানিপাড়ার শুরুতেই বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে রয়েছে এই কুয়াটি।  
সীমা বৌদ্ধ মন্দির :কুয়াকাটার প্রাচীন কুয়াটির সামনেই রয়েছে প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মন্দির, নাম সীমা বৌদ্ধ মন্দির। আগে মন্দিরটির স্থাপনা ছিল কাঠের তৈরি। পরে এটি দালানে রূপান্তরিত করা হয়। প্রাচীন এই মন্দিরে রয়েছে প্রায় সাঁইত্রিশ মণ ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি।
কেরানিপাড়া :সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকেই শুরু হয়েছে রাখাইন আদিবাসীদের পল্লী কেরানিপাড়া। এখানকার রাখাইন নারীদের প্রধান কাজ কাপড় বুনন। এদের তৈরি শীতের চাদর বেশ আকর্ষণীয়।
আলীপুর বন্দর :কুয়াকাটা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় একটি মাছ ব্যবসা কেন্দ্র আলীপুর। এ বন্দর থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রলার বঙ্গোপসাগরে যায় মাছ ধরতে। আলীপুর বন্দর ঘুরে দেখতে পারেন বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক মাছের বিশাল আয়োজন।
মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির :কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে রাখাইন আদিবাসীদের আরেকটি বাসস্থল মিশ্রিপাড়ায় রয়েছে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির। এ মন্দিরেই রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি। এখান থেকে কিছু দূরে আমখোলা পাড়ায় রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাখাইন বসতি। 
গঙ্গামতির জঙ্গল :কুয়াকাটা সুমুদ্রসৈকত পুবদিকে শেষ হয়েছে গঙ্গামতির খালে গিয়ে। আর এখান থেকেই শুরু হয়েছে গঙ্গামতির বা গজমতির জঙ্গল। বিভিন্ন রকম গাছপালা ছাড়াও এই জঙ্গলে দেখা মিলতে পারে বন মোরগ, বানর ও নানা রকম পাখির।
ফাতরার বন :কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম প্রান্তে নদী পার হলেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এরই নাম ফাতরার বন। এ জায়গাটি অবিকল সুন্দরবনের মতো হলেও হিংস্র কোনো বন্যপ্রাণী নেই বললেই চলে। বন মোরগ, বানর আর বিভিন্ন রকম পাখিই এ বনে বেশি দেখা যায়। খুবই কম পরিমাণে দেখা মিলে বন্য শুকরের। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার বনে যেতে হলে লাগবে ইঞ্জিন বোট। সারা দিনের জন্য মাঝারি মানের একটি ইঞ্জিন নৌকার ভাড়া ১৫০০- ২০০০ টাকা।
কীভাবে যাবেন :ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো যোগাযোগব্যবস্থা হলো সদরঘাট থেকে লঞ্চে পটুয়াখালী। সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী রুটে চলাচল করে এমভি দ্বীপরাজ, সৈকত ইত্যাদি লঞ্চ। এসব লঞ্চে প্রথম শ্রেণীর দ্বৈত কেবিনের ভাড়া ৮৫০-১০০০ টাকা। পটুয়াখালী বাস স্টেশন থেকে প্রতি ঘণ্টায় কুয়াকাটার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৬০-৭০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে লঞ্চে বরিশাল এসে সেখান থেকেও বাসে চড়ে কুয়াকাটা আসা যায়। ঢাকা থেকে বরিশাল ও পটুয়াখালীর লঞ্চগুলো ছাড়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায়। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসও চলে কুয়াকাটার পথে। কমলাপুর বিআরটিসি বাস স্টেশন থেকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ছাড়ে সরকারি পরিবহন সংস্থার বাস। আর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে কুয়াকাটার পথে চলে সাকুরা, সুরভী, দ্রুতি ইত্যাদি পরিবহনের বাস। ভাড়া ৪৫০-৫৫০ টাকা। 
কোথায় থাকবেন :কুয়াকাটায় থাকার জন্য এখন বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল আছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন হলিডে হোমস। ফোন :ঢাকা কার্যালয়—৮৮১১১০৯, ৯৮৯৯২৮৮, কুয়াকাটা— ০৪৪২৮-৫৬০০৪। হোটেল স্কাই প্যালেস, ফোন :ঢাকা বুকিং কার্যালয়—৭১০০৫৯০, ০১৭১১৫৪২৮৮১। কুয়াকাটা—০৪৪২৮-৫৬০২৬, ০১৭২৭০৩০২৪৮। হোটেল নীলাঞ্জনা ইন্টারন্যাশনাল, ফোন :০১৭১৩০২৪০৮৭। হোটেল গোল্ডেন প্যালেস, ফোন :ঢাকা বুকিং কার্যালয়—০১৭১৫০৬১২০১, কুয়াকাটা—০৪৪২৮-৫৬০০৫,  ০১৭১১৪৪১৬২২। হোটেল সাগর কন্যা, ফোন ঢাকা কার্যালয়—৮৩১৪০৬১, ০১৭২০২০৯০২৯, কুয়াকাটা—০৪৪২৮-৫৬০২০, ০১৭২০২০৯০২৯। এসব হোটেলে ৫০০-২৫০০ টাকায় বিভিন্ন মানের কক্ষ আছে।
জেনে রাখা ভালো :কুয়াকাটা ভ্রমণে যাওয়ার আগে একটি কথা আগেই জেনে যাওয়া ভালো। সুন্দর এ পর্যটন কেন্দ্রটি সরকারের কাছে বরাবরই উপেক্ষিত। তাই পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সড়কের বেহাল দশার কারণে প্রায় আড়াই ঘণ্টার এ পথটুকু পেরোতে কিছুটা কষ্ট হবে পর্যটকদের। সাগরকন্যার সৌন্দর্য দেখার পরে সে কষ্ট অনেকের কাছেই সামান্য মনে হবে। কুয়াকাটার পাশ্ববর্তী দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত বাহন মোটর সাইকেল।

লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজমামুন

No comments:

Post a Comment