Pages

Saturday, July 28, 2012

এই তো মাধবপুর হ্রদ


madhabpur

আরেকটু হলেই মিস হয়ে যেত। হাতে সময় ছিল মাত্র তিন ঘণ্টা। আগের তিন দিন পুরো শ্রীমঙ্গল চষে বেড়িয়ে আমরা যখন ঢাকা ফেরার ট্রেনের অপেক্ষায় ঠিক তখনই মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মজিদ অনেকটা হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘সব জায়গায় তো গেলেন, মাধবপুর লেকটাই তো দেখলেন না।’ আমাদের নিয়ে মাইক্রোবাস সবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পেরিয়েছে। আমরা সবাই গাড়ির মধ্যেই হইচই করে উঠলাম। ‘দেখব না মানে, আলবৎ দেখব।’ গাড়িতে ছোট-বড় মিলে ১৫ জনের চিৎকারে ড্রাইভারের ভিরমি খাওয়ার দশা। ভাবটা এমন, বলেও দেখি বিপদ! ঘড়িতে তখন ১২টা ১০ মিনিট। আমাদের ট্রেন তিনটায়। ট্রেন মিস করার ভয়টা যে একেবারেই নেই তা নয়। তার পরও আমাদের সাজ্জাদ ভাই (সাজ্জাদ শরিফ, উপসম্পাদক, প্রথম আলো) একেবারে দলনেতার মতো সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন। গাড়ি ছুটে চলল দুই দিকের সবুজ চা-বাগানের মাঝের রাস্তা দিয়ে মাধবপুরের দিকে। গন্তব্য মাধবপুর হ্রদ।
একদম মসৃণ পিচঢালা রাস্তা নয়। বরং মাঝেমধ্যে একটু হোঁচট খেতে হয়। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর আমরা গেটে পৌঁছালাম। গেট বলতে মাধবপুর টি-এস্টেটের প্রবেশদ্বার। মাধবপুরের এই টি-এস্টেটটি ন্যাশনাল টি-কোম্পানির অধীনে। সিলেটের ভৌগোলিক মানচিত্রে এর অবস্থান কমলগঞ্জ উপজেলায়। গেটম্যান সদা প্রস্তুত। দ্বার উন্মোচন হতেই আমাদের গাড়ি ঢুকে পড়ল চা-বাগানে। কিন্তু কোথায় হ্রদ? শাওন আপা, টিনা আর দীপা আপা সবাই অস্থির হ্রদ দর্শনে। সবার উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে নির্বিকার মজিদ ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করল অনেকটা আচমকাই। পার্কিং দেখেই বুঝলাম, গাড়ির রাস্তা শেষ। এবার হন্টন। শুধু আমাদেরটাই নয়, পার্কিংয়ে আছে আরও বেশ কয়েকটি গাড়ি। আর এই গাড়ির পর্যটকদের ঘিরেই পার্কিংয়ে জমে উঠেছে কয়েকটি টিস্টল। ওখান থেকে জানা গেল, আর মাত্র দুই মিনিট হাঁটলেই মাধবপুর লেক। কোনোভাবেই চায়ের তৃষ্ণাটা যাচ্ছিল না। তাই ওই বাগানের গরম চা খেলাম আমরা সবাই। শীতের আমেজে অপূর্ব স্বাদ সেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের।
লক্ষ্মীকান্ত চৌহান। আদিনিবাস ভারতবর্ষে। চাকরি সূত্রে বহু বছর এই মাধবপুর টি-এস্টেটে। কীভাবে যেন জুটে গেলেন আমাদের সঙ্গে। আমরা হাঁটছি আর লেকের গল্প শুনছি তাঁর কাছ থেকে। জানা গেল, প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ। চা-বাগানের মেঠোপথে হাঁটার সময় চোখে পড়ল নানা বনৌষধি গাছ। আমলকী, হরীতকী, বহেরা কী নেই? দেখলাম চাগাছের নার্সারিও। চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, বীজগাছের পাতা থেকে নাকি চা ভালো হয় না। শুধু চা-পাতার জন্য কলম গাছাই উৎকৃষ্ট।
বড়সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। মেঠোপথ দিয়ে একটু উঁচুতে উঠতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। কোথায় এলাম? এত সুন্দর! চারদিকে অজস্র ছোট-বড় টিলার মধ্য দিয়ে নয়নাভিরাম হ্রদ। মনে হচ্ছিল ক্যানভাসে আঁকা ছবি দেখছি। পাশ থেকে চৌহান বললেন, ‘ওই টিলাগুলোর ওপর থেকে লেক আরও সুন্দর লাগবে, চলেন টিলার ওপর যাই।’ কিন্তু আমরা নির্বাক, দুই চোখ দিয়ে শুধু দেখছি সামনের অপার সৌন্দর্য। শুভ ভাই ভাঙলেন নীরবতা। ক্যামেরার ক্লিক শব্দে ফিরে এলাম বাস্তবতায়। হ্রদের টলমল পানিতে ফুটে আছে বেগুনি শাপলা। বাচ্চাদের সে কী চিৎকার! ওরা কখনো বেগুনি শাপলা দেখেনি। জানা গেল, এই শাপলা বহু বছর ধরে হ্রদের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য।
এবার টিলায় ওঠার পালা। হ্রদ দর্শন হবে উঁচু থেকে। প্রায় ২০ মিনিট চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছালাম সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপর। টিলার ওপর আছে বসার জায়গা। ওখানে বসার আগ্রহ দেখা গেল না কারও। উঁচু থেকে হ্রদ দর্শনের লোভ সবার। সবুজ ঘন টিলাগুলোর মাঝ দিয়ে টলমলে পানি এঁকেবেঁকে গেছে। পাহাড়ি ফুল আর শাপলা যেন তার গয়না। শীতের দুপুরের নরম রোদের আলো আছড়ে পড়ছে চারদিকের টিলায়। আর তার ছায়া পড়েছে হ্রদের ফটিকসদৃশ হ্রদের পানিতে। সে এক মায়াময় দৃশ্য। পাশে দাঁড়ানো চৌহান ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনারা একটু বাঁয়ে তাকান। ওই যে মেঘের মাঝে পাহাড়গুলো দেখছেন, ওটা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য।’ সত্যিই তো তাই। টিলার পূর্বদিকে মেঘের রাজ্যে ত্রিপুরাকে দেখে আমরা সবাই বিস্মিত। এত কাছে ত্রিপুরা। জানা গেল এখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমানা। আর সেখানেই বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ।
এবার নামার পালা। হ্রদ পেরিয়ে আমরা যেদিক দিয়ে টিলায় উঠেছি, এবার নামলাম তার উল্টো দিক দিয়ে। হ্রদের পাশ দিয়ে মসৃণ রাস্তা বানিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। পর্যটকদের সুবিধার জন্য এই রাস্তা তৈরি। শুনলাম অচিরেই পর্যটকদের জন্য আরও কিছু আয়োজন করতে চলেছে বাগান কর্তৃপক্ষ। এই হ্রদ ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনাও আছে তাদের। এই বদ্ধ হ্রদটি খরার দিনে শুধু চা-বাগানেরই তৃষ্ণা মেটাবে না, প্রকৃতিপ্রেমীরাও তাঁদের আকণ্ঠ ভরে পান করবেন প্রকৃতিসুধা।
হ্রদ দর্শনের খুঁটিনাটি
 ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন ট্রেনে। পারাবত, জয়ন্তিকা অথবা উপবনে। শ্রীমঙ্গলে নেমে বাসে এক ঘণ্টার পথ মাধবপুর টি-এস্টেট। অথবা শ্রীমঙ্গল থেকে মাইক্রোবাসও নিতে পারেন। ট্রেন অথবা বাসে সাকল্যে খরচ হবে জনপ্রতি ৪০০ টাকা।
 থাকতে পারেন শ্রীমঙ্গল অথবা কমলগঞ্জে। শ্রীমঙ্গলে ভালো হোটেল পাবেন। আর কমলগঞ্জে এনজিওর গেস্ট হাউস আছে। থাকা খরচ বাবদ প্রতি রাত এক হাজারের মধ্যে।
 মাধবপুর টি-এস্টেটের আশপাশে রেস্টুরেন্ট নেই। তাই আপনাকে কষ্ট করে তিন কিলোমিটার দূরে ভানুগাছে যেতে হবে খাওয়ার জন্য। অথবা প্যাকেট খাবার কিনে নিতে পারেন।
 স্যান্ডেল অথবা জুতা না পরে কেডস পরবেন। টিলায় উঠতে সুবিধা হবে।
 হ্রদ দর্শনে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না।
 বাগানে বসে বাগানের চা খেতে ভুলবেন না। এটি অন্য রকম এক মজা।
 যদি পিকনিক করতে চান, বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নিতে পারেন। পিকনিক করতে কোনো বাধা নেই। সারা দিন কেটে যাবে নয়নাভিরাম লেকে।
স্বরূপ সোহান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৪, ২০১০

No comments:

Post a Comment