++সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিযায়ী পাখি আর মাছের অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওর। খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের কোলের এ হাওরে শীতে বসে পাখিদের মেলা। এ ছাড়া জানুয়ারি-মার্চ এই তিনমাস চলে এ হাওরে মাছ ধরার মহোত্সব। কড়চা’র এবারের বেড়ানো পাখি দেখতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে।
সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের দশটি মৌজা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের বিস্তৃতি। মৌজা দশটি হলো—জগদীশপুর, ভবানিপুর, লামাগাঁও, রামসিংহপুর, মহজমপুর, মেইন দাগ, মায়াজুড়ি, পূর্ব ভাঙ্গাচড়া, নোয়াগাঁও ও টাঙ্গুয়ার হাওর। ছোট বড় ১২০টি বিল রয়েছে এ হাওরে। ৪৬ গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ২৮০২৩৬ হেক্টর জলাভূমি। প্রতি বছর এ হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। এ ছাড়াও হাওরে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস।
টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে ১৪০টিরও বেশি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কাতল, আইড়, বোয়াল, গাং মাগুর, বাইম, তারা বাইম, গুলশা, গুতুম, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া, বেতি, কাকিয়া ইত্যাদি। টাঙ্গুয়ার হাওরের রুই মাছের স্বাদ অপূর্ব। শীতে টাঙ্গুয়ায় যেসব পাখি বেশি দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সাপ পাখি, পানকৌরি, বড় পানকৌরি, ছোট পানকৌরি, ছোট ডুবুরি, বড় খোপা ডুবুরি, বড় বক, ছোট বক, ধুপনি বক, বেগুনি বক, মেটে রাজহাঁস, চখাচখি, ছোট সরালি, বড় সরালি, লেনজা হাঁস, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিথি হাঁস, পাতি হাঁস, বালি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি, জল মোরগ, লালবুক গুরগুরি, নেউ পিপি, কায়েম, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, তিলা লালপা, লালপা, সবুজপা, বিল বাটান, সোনালি বাটান, কালোমাথা তাঙচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কুরা, বড় চিত্রা ঈগল, তিলা নাগ ঈগল ইত্যাদি।
টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় বিল। যেগুলো পাখির স্বর্গরাজ্য। উল্লেখযোগ্য বিলগুলো হলো—লেউচ্ছামারা, রৌয়ার বিল, গজারিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার, সাংসার বিল, কৈখালি বিল, ছুনখোলা বিল, জিততলার গোপ, ফইল্লার বিল, রোপা ভুই বিল, সত্তার বিল, মইষের গাতা, বেরবিয়ার বিল, বালোয়ার ডোবা, আমছারের বিল, কাউয়ার বিল, আনসারের বিল, খাজুরি বিল, আইন্নার বিল, নলকাঠির বিল ইত্যাদি। টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে দুটি পাখির ও পাঁচটি মাছের অভয়ারণ্য। পাখির দুটি অভয়ারণ্য হলো লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল। আর মাছের পাঁচটি অভয়ারণ্য হলো রোপাভূই, রৌয়ারবিল, তেওনিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার এবং বালুয়ার ডোবা।
তিন মাস ছাড়া পুরো বছরটাতেই টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ধরা নিষেধ। পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত জেলেদের মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয় এখানে। এ সময়ে শত শত জেলে নৌকা হাওরে মাছ ধরায় ব্যস্ত থাকে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ঠিক মাঝখানটায় সুন্দর বিল হাতিরগাতা। এর চারপাশে রয়েছে বিলগুলো। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা শীতে শুকিয়ে যাওয়া মাঠে হাতি চড়াতে আসতেন বলেই এই নাম পেয়েছে জায়গাটি। সুনামগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলে গেলে পথে পড়বে বরছড়া ও সারাগাঁও কয়লাকেন্দ্র, টেকেরঘাট চুনাপাথর প্রকল্প। সর্বশেষ বাগলী বাজার ছেড়ে মোটর বাইক নিয়ে সোজা চলতে হবে শুকনো বিলের পথে। আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে একসময় এসে পৌঁছানো যাবে হাতিরগাতায়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন (০১৭১৪৫৩৭৯১৬), মামুন পরিবহনের (০১৭১১৩৩৭৮৫১, ০১৭১৮৪৩৮৭৩২) নন এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া এসি ৪০০-৫০০ টাকা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সড়কপথে সুনামগঞ্জের জেলা সদরের সঙ্গে সিলেটের বাস সার্ভিস আছে। সুনামগঞ্জ পৌঁছে সাহেববাড়ি ঘাট থেকে গুদারায় (পারাপারের নৌকা) আসতে হবে মনিপুরী ঘাট। সেখান থেকে বিভিন্নভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা যায়। প্রথমত মনিপুরী ঘাট থেকে ভাড়া মোটর সাইকেলে সরাসরি হাতিরগাতা। প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দূরত্বের এ পথে একটি মোটর সাইকেলের ভাড়া পড়বে ৪০০-৬০০ টাকা। পথে বেশ কয়েকটি বাঁশের সাঁকো পার হতে হবে টোল দিয়ে। সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা প্রায়। এ ছাড়া মনিপুরী ঘাট থেকে মোটর বাইকে শ্রীপুর বাজার কিংবা সোলেমানপুর এসেও সেখান থেকে নৌকায় হাতিরগাতায় আসা যায়। একটি ইঞ্জিন নৌকার ভাড়া পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা। খুব সকালে সুনামগঞ্জ থেকে যাত্রা করলে টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌঁছুতে দুপুর হয়ে যায়।
কোথায় থাকবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। হাওরের মাঝে থাকতে চাইলে হাতিরগাতায় অবস্থান করা সম্ভব। এখানে আইইউসিএন-এর ক্যাম্প এলাকায় অবস্থান করাটা নিরাপদ। তবে সঙ্গে অবশ্যই তাঁবু ও স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যেতে হবে।
সঙ্গে যা নেবেন
তাবু, স্লিপিং ব্যাগ, হেড ল্যাম্প, শীতের কাপড়, রোদ টুপি, প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, কেডস, সেন্ডেল, পতঙ্গ নিরোধক ক্রিম ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় খাবারও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। হালকা বহনযোগ্য ক্যাম্পিং চুলা নিয়ে গেলে সহজে রান্না করেও খেতে পারবেন। হালকা খাবার সঙ্গে নিয়ে নিন। কারণ হাওর থেকে হাটের দূরত্ব অনেক বেশি।
মনে রাখবেন
টাঙ্গুয়ার হাওর পাখির অভয়ারণ্য। এখানে ভ্রমণে গেলে পাখিদের বিরক্ত করবেন না। পাখি শিকার করবেন না। হাওরে প্লাস্টিকের বোতল, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, কোনো রকম পলিথিন ফেলে পরিবেশ দূষণ করবেন না। এ জাতীয় জিনিস সঙ্গে ফেরত এনে কোনো ডাস্টবিনে ফেলুন। হাওরে এ সময়ে মশা ও পোকা মাকড়ের উপদ্রব অনেক বেশি। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে নিন। জায়গাটিতে বিদ্যুত্ নেই। তাই মোবাইল ফোন ক্যামেরার পর্যাপ্ত ব্যাটারি, মেমোরি কার্ড সঙ্গে নিয়ে নিন।
লেখক: মুস্তাফিজ মামুন
No comments:
Post a Comment