Pages

Saturday, July 28, 2012

চট্টগ্রামের ফয়’স লেকে ভ্রমণ


Details
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর খুলশী এলাকায় মনোরম একটি পর্যটনকেন্দ্র ঐতিহাসিক ফয়’স লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিনশ’ ফুট উঁচু এ লেক সারা বছরই জলে পূর্ণ থাকে। চারিদিকে অসংখ্য ছোট পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বিস্তৃত এই পর্যটনকেন্দ্রটি। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক ১৯২৪ সালে প্রায় ৩৩৬ একর জায়গায় কৃত্রিম এ হ্রদটি খনন করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় অযত্নে পড়ে থাকায় একসময় জৌলুশ হারাতে বসে প্রাচীন এই লেক। ফয়’স লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০০৫ সালে কনকর্ড সেখানে গড়ে তুলেছে আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট।
অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড :খুলশীর প্রধান সড়কের পাশে আধুনিক তোরণই বলে দেয় ফয়’স লেকের অবস্থান। এই তোরণ পেরিয়ে ভেতরে কিছুটা পথ গেলেই এর মূল প্রবেশ পথ। এখানে টিকেট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই বেশ কিছু রাইড। সার্কাস সুইং, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, জায়ান্ট ফেরিস হুইল, ড্রাই স্লাইড, ফ্যামিলি ট্রেইন, প্যাডেল বোট, ফ্লোটিং ওয়াটার প্লে, পাইরেট শিপের মতো বিশ্বের আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের সব রাইড। এখান থেকে সিঁড়ি ভেঙে উপরে রয়েছে বনভোজন কেন্দ—‘ফটো কর্নার’। সেখান থেকে আরও সামনে গেলে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এখানে থেকে পাখির চোখে দেখা যাবে গিরি শহর চট্টগ্রামকে। অ্যামিউজমেন্ট পার্কের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড রেস্টুরেন্টে পাওয়া যাবে মজাদার সব খাবার। রেস্তোরাঁটির পাশের লেকে ফিশিং পয়েন্টে দেখা মিলবে হরেক মাছের খেলা। গিফট শপে পাওয়া যাবে নানা রকম উপহার আর সুভ্যেনির সামগ্রী।
লেকের জগত্ :অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের উত্তরে কৃত্রিম ঝরনার দুপাশে সিঁড়ি ভেঙে একটু উপরে উঠলেই মূল ফয়’স লেক। লেকের দু’পাশে সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। আসমানি, গগনদ্বীপ, জলটুঙ্গি আরও কত মজার নামের পাহাড়। এসব পাহাড়ের কোনো কোনোটির সংরক্ষিত বনে খেলা করে চিত্রা হরিণ, খরগোশ আরও কত কী! লেকে ভ্রমণেরও নানা আয়োজন আছে এখানে। আছে নানা আকারের ইঞ্জিন চালিত ফাইবার বোট, স্পিড বোটসহ আছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা সাম্পান। আধা ঘণ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে লেক ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। লেকের সামনে কাঁচ ঘেরা ‘লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট’। মুখরোচক খাবার খেতে খেতে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার ব্যবস্থা আছে এখানে।
সি-ওয়ার্ল্ড :এ এক ভিন্ন জগত্। ফয়’স লেকের একপ্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে জলের রাজ্যে রোমাঞ্চকর এ রাজ্যেটি। শহরের সিটি গেট সংলগ্ন সড়ক দিয়ে গেলে সরাসরি প্রবেশ করা যাবে সি-ওয়ার্ল্ডে। তবে মূল প্রবেশ পথে সি-ওয়ার্ল্ডে গেলে লেকের গোড়া থেকে চড়তে হবে ইঞ্জিন নৌকায়। সি-ওয়ার্ল্ডের টিকেট কিনলেই নৌকাযোগে নিয়ে যাওয়া হবে সেখানে। ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে লেকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দশ মিনিটে পৌঁছে দেবে সি-ওয়ার্ল্ডের দুয়ারে। জলের রাজ্যে বেড়ানোর মজার আর রোমাঞ্চকরসব রাইডে সমৃদ্ধ এ জায়গাটি। উঁচু একটি জায়গা থেকে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পুলে ধপাস্ করে পড়ার মজা পাওয়া যাবে এখানকার স্লাইড ওয়ার্ল্ডে। আছে টিউব স্লাইড, যা অনেকটা স্লাইড ওয়ার্ল্ডের মতোই। তবে এখানে স্লাইড পাড়ি দিতে হবে টিউবে চড়ে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজা করার জন্য আছে ফ্যামিলি পুল। এ ছাড়াও মাল্টি স্লাইড, ওয়াটার ফল, ডুম স্লাইড, প্লে জোন, ড্যান্সিং জোনের মতো মজার সব রাইড। চিলড্রেন পুলে শিশুদের পানিতে খেলার জন্য আছে অনেকগুলো রাাইড। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষর্ণীয় রাইড ‘ওয়েবপুল’। এটি মূলত একটি কৃত্রিম সমুদ্রসৈকত। বিশাল আয়তনের এই সৈকতে আছে সমুদ্রের মতোই বড় বড় ঢেউ। এত বড় ঢেউয়ের মধ্যেও নামতে কোনো ভয় নেই। টিউবে চড়ে ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো যায় ইচ্ছেমতো। সি-ওয়ার্ল্ডে যেতে হলে অবশ্যই ভিজতে হবে সবাইকে। তাই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে বাড়তি পোশাক আর তোয়ালে। তবে না নিলেও সমস্যা নেই। এখানে এসব ভাড়া কিংবা কিনতেও পাওয়া যাবে। স্নান ও পোশাক বদলানোর জন্য মহিলা ও পুরুষদের আলাদা কক্ষ আছে।
রিসোর্ট :প্রকৃতির মাঝে নির্জনতায় অবকাশ যাপনের জন্য এখানে রয়েছে ফয়’স লেক রিসোর্ট। সি-ওয়ার্ল্ডের পাশেই এর অবস্থান। রিসোর্টেও যেতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে অবসর কাটানোর জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। লেক ও পাহাড়মুখী দু ধরনের ঘরই আছে এখানকার রিসোর্টে। বারান্দায় বসে লেক আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা আছে এখানে। ঋতুভেদে ফয়’স লেকের সৌন্দর্যে ভিন্নতার দেখা মেলে। এখানে অবকাশ যাপনে সারা বছরই তাই সবার ভালো লাগবে। মধুচন্দ্রিমার জন্যও এখানকার রিসোর্ট আকর্ষণীয় জায়গা।
প্রয়োজনীয় তথ্য :দর্শনার্থী কিংবা পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে ফয়’স লেক বিভিন্ন সময় নানা রকম অফার দিয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ আয়োজনও থাকে এখানে। কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্টের সহকারী ব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিত ঘোষ জানালেন, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ অন্যান্য বিশেষ দিনগুলোতে দর্শকদের জন্য দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের কনসার্টের আয়োজন থাকে ফয়’স লেকের অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডে। শিশুদের জন্যও এসব দিনে থাকে নানা আয়োজন। সারা বছরই খোলা থাকে ফয়’স লেক। শীতকালীন সময়সূচি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা আর গ্রীষ্মকালীন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা। যোগাযোগ :০৩১-২৫৬৬০৮০, ০১৯১৩৫৩১৩৭৭-৭৮।
খরচপাতি  :ফয়’স লেকের অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের প্রবেশ মূল্য ছোটদের ১০০ টাকা, বড়দের ১৮০ টাকা। ৩ ফুটের চেয়ে কম উচ্চতার শিশুদের প্রবেশ মূল্য লাগে না। এখানকার বিভিন্ন রাইডে চড়ার আলাদা আলাদা মূল্য রয়েছে। তবে প্রবেশ ও সব রাইডের বিশেষ প্যাকেজও আছে। সেজন্য বড়দের ২৮০ টাকা, ছোটদের ২৫০ টাকা।  সি-ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ ও সব রাইডের প্যাকেজ হলো ৩০০ ও ৪৩০ টাকা।  এ ছাড়া ফয়’স লেকে নৌভ্রমণে পুরো একটি ইঞ্জিন নৌকা আধা ঘণ্টার জন্য নিলে লাগবে ৭৫০ টাকা। এ ছাড়া আধাঘণ্টার জন্য চড়লে জনপ্রতি ১৫০ টাকা, সঙ্গে থাকছে স্ন্যাকস ও কফি। এ ছাড়া নির্দিষ্ট মূল্যে স্পিড বোট ও সাম্পানে চড়ে লেক ভ্রমণের ব্যবস্থাও আছে এখানে। বনভোজন করার সব রকম ব্যবস্থা আছে ফয়’স লেকে। কমপক্ষে ৫০ জনের দল এখানে বনভোজনে এলে মিলবে বিশেষ ছাড়। বনভোজনকারীদের খাবারেরও ব্যবস্থা করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এখানকার রিসোর্টের কক্ষ ভাড়া ৪৯৫০ টাকা থেকে শুরু।
কীভাবে যাবেন :ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে। ঢাকার বাসগুলো সাধারণত শহরে প্রবেশ করে ফয়’স লেকের সামনের সড়ক থেকেই। শহরের যেকোনো জায়গা থেকে খুব সহজেই ফয়’স লেক আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে গ্রিনলাইন (০২-৭১০০৩০১), সোহাগ (০২-৯৩৪৪৪৭৭), সৌদিয়া (০১১৯৭০১৫৬১০), টি আর (০২-৮০৩১১৮৯), হানিফ (০১৭১৩৪০২৬৭১) ইত্যাদি পরিবহনের এসি বিলাসবহুল বাস যায় চট্টগ্রামে। ভাড়া ৭৫০-১০৫০ টাকা। আর এস আলম, সৌদিয়া, ইউনিক, শ্যামলী, হানিফ, ঈগল প্রভৃতি পরিবহনের সাধারণ মানের বাসের ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকা। রেলপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের পথে মহানগর প্রভাতী ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে, চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৯টা বিশ মিনিটে, মহানগর গোধূলি ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩টায়, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে, তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত এগারোটায়। ভাড়া এসি বার্থ ৭৫৬ টাকা, এসি সিট ৪৫৫ টাকা, প্রথম শ্রেণী বার্থ ৪৫৫ টাকা, প্রথম শ্রেণী চেয়ার ২৯০ টাকা, স্নিগ্ধা শ্রেণী ৩৮০ টাকা, শোভন চেয়ার ১৫০ টাকা, শোভন ১২৫ টাকা, সুলভ ১০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান (০২-৯৫৬০১৫১-১০), জিএমজি এয়ারলাইন্স (০২-৮৯২২২৪৮) ও ইউনাইটেড এয়ার (০২-৮৯৫৭৬৪০), রিজেন্ট এয়ার (০২-৮৯৫৩০০৩)-এর বিমানে সরাসরি যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে।

লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন

No comments:

Post a Comment