সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শরণখোলা রেঞ্জের অধীন সমুদ্র ছোঁয়া দুটি পর্যটন কেন্দ্র কটকা ও কচিখালী অভয়ারণ্য। পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় এ দুটি স্থান শীর্ষে। সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ বাঘের অবাধ বিচরণ এখানে। এ ছাড়াও চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর, লোনা জলের কুমির আর নানান পাখির দেখা মেলে জায়গা দুটিতে।
কটকা অভয়ারণ্য
কটকায় ভ্রমণে গেলে লঞ্চ নোঙ্গর করা হয় কটকা খালে। খালের পশ্চিম পাড়ের জেটি পেরিয়ে উপরে উঠলেই বন কার্যালয়। এর সামনে দিয়ে সোজা পশ্চিমমুখী ইট বাঁধানো পথটি কিছু দূর চলার পরে শেষ। এর পরে আরেকটু সামান্য গেলে সমুদ্র। সূর্যাস্ত দেখার জন্য উপযুক্ত যায়গা। কটকা বন কার্যালয়ের পেছন দিক থেকে সোজা পশ্চিমমুখী কাঠের তৈরি ট্রেইল। এটিরও শেষ হয়েছে আগের জায়গাটিতে। ট্রেইলের উত্তর পাশের মরাখালটির তলায় ভাটার সময় উঁকি মারে ঘন শ্বাসমূল। নিরবতা অবলম্বন করে চুপিচুপি চললে এখানে দেখা মিলবে চিত্রা হরিণের দল। ট্রেইলের শেষ মাথায় হাতের ডানে সোজা দক্ষিণে মিনিট বিশেক হাঁটলে টাইগার টিলা। এ টিলায় প্রায়ই বাঘ মামার তাজা পায়ের ছাপ চোখে পড়ে। টিলার গাছের ছালে দেখা যায় বাঘের নখের দাগ। টাইগার টিলা থেকে সামান্য পশ্চিমে বয়ার খাল। দুই পাশে কেওড়া, গোলপাতা। নানান পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে জায়গাটি। কটকার জেটির উত্তরে খালের চরে আকাশ ছোঁয়া দীর্ঘ কেওড়ার বন। এ জায়গাটিতে সকাল-বিকাল দেখা যায় দলে দলে চিত্রা হরিণ। বানর আর শূকরেরও দেখা মেলে এ চরে। কেওড়ার ডালে এখানে প্রায়ই বসে থাকতে দেখা যায় সুন্দরবনের বৃহত্ পাখি মদনটাক। এ চরে মাঝে মাঝে বিশেষ করে শীতের প্রকোপ বাড়লে দেখা মেলে লোনা জলের কুমির। খালের পূর্ব চরেও কুমিরেরা শীতে রোদ পোহাতে শুয়ে থাকে। কটকা বন কার্যালয়ের ঠিক ওপারে ছোট খাড়ি চলে গেছে সোজা পূবে। কিছু দূর যাওয়ার পরে হাতের ডানে ছোট্ট জেটি। ওপরে ওয়াচ টাওয়ার। এ খালে দেখা যায় হাঁসের মতো দেখতে সুন্দরবনের অতি বিপন্ন মাস্কফিনফুট। ওয়াচটাওয়ারের জেটি ছেড়ে সামান্য পুবে হাতের বাঁয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি খাল। এ খালে দেখা যায় উদবিড়ালের দল। আরো নানান বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে এ খালে। এ খাড়িতে বন্যপ্রাণীর সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে সকালে।
কটকার ওয়াচ টাওয়ারটি চারতলা বিশিষ্ট। টাওয়ারের পশ্চিম পাশে ঘন জঙ্গল। পুবে আর দক্ষিণে দীর্ঘ ছন বন। মাঝে মিঠা জলের পুকুর। হরিণেরা জলপান করতে প্রায়ই এ পুকুরে আসে। মাঝে মাঝে হেতালের ঝোপ আর টাইগার ফার্ন। বাঘের লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা এগুলো। বিকেলে এ ছন বনে দলে দলে হরিণ নামে ঘাস খেতে। ওয়াচ টাওয়ারে চুপি চুপি কিছুক্ষণ বসে থাকলে সে দৃশ্য দেখা কঠিন কিছু নয়।
জামতলা সমুদ্রসৈকত
কটকা ওয়াচ টাওয়ারকে পিছু ফেলে সোজা উত্তরে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে গেলে জামতলা সমুদ্র সৈকত। পথে চলতে চলতে বিভিন্ন আকারের জামগাছ সৈকতটির নামের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। জামতলা সৈকতটি নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন। বেলাভূমিজুড়ে শুধুই দেখা যায় কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম। কোথাও কোথাও দেখা যায়, জোয়ারের ঢেউয়ে ধুয়ে যাওয়া গাছের শেকড়। সৈকতটি সোজা পুবে গিয়ে শেষ হয়েছে কচিখালিতে। জামতলা সমুদ্র সৈকতটি স্নানের জন্য আদর্শ জায়গা নয়।
কচিখালী
কটকা থেকে খুবই কাছের একটি আকর্ষণীয় জায়গা কচিখালী অভয়ারণ্য। এটিও শরণখোলা রেঞ্জের অধীন। কটকা থেকে কচিখালী যাবার বেশ কয়েকটি পথ আছে। প্রথমত, জামতলা সৈকত ধরে প্রায় সাত কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছা যায় কচিখালীতে। কটকা থেকে কচিখালী যাবার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পথটি হলো ছিটে কটকার খাল ধরে যাওয়া। এ খালে জোয়ারের সময় মাঝারি আকারের লঞ্চ চলতে পারে। এ পথে কচিখালী যেতেও লাগে ঘণ্টা দুয়েকের মতো। এ ছাড়া বড় কটকার খাল ধরে গেলে সময় লাগে কিছুটা বেশি। তবে বড় কটকার থেকে ছিটে কটকার সৌন্দর্য অনেকগুণ বেশি।
কচিখালীতেও বাঘের আনাগোনা বেশি। জেটি পেরিয়ে উপরে উঠলে প্রথমেই বন কার্যালয়। এখান থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে ছন বন। মাঝে মিঠা জলের পুকুর। ছন বনটির শেষ সীমানা ঠেকেছে গিয়ে সমুদ্র সৈকতে। বনের পশ্চিম পাশটায় ঘন জঙ্গল। কচিখালী জেটির উত্তর পাশে নদীর চরে খুব সকালে প্রায়ই দেখা যায় বন মোরগের দল। তাছাড়া এখানে আরো দেখা মেলে হরিণ, শূকর, বানর ইত্যাদি। এখান থেকে সামান্য উত্তরে ছোট্ট একটি খাল বনের বুক চিরে সোজা পশ্চিমে চলে গেছে। একটু ভেতরের দিকে এ খালের জল সারা বছরই টলটলে স্বচ্ছ থাকে। এ খালের তীরে কেওড়া গাছে দেখা গেছে বিশাল অজগর। নানা রকম পাখিও দেখা যায় এখানে। এ খাল থেকে বেরিয়ে কিছুটা উত্তরে নদীর চরে শীতের সময় প্রায়ই দেখা যায় লোনা জলের কুমির।
কচিখালী সৈকত
কচিখালী জেটির দক্ষিণ পাশে নদীর তীর ধরে আধা ঘণ্টা হাঁটা পথের দূরত্ব কচিখালী সমুদ্র সৈকতের। বন কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশে ছন বন ধরে হেঁটে গেলে সময় লাগবে ঘণ্টা খানেকের বেশি। এ সৈকতটির শেষ সীমানা জামতলা পর্যন্ত। রাতে এ সৈকতে বাঘ চলাফেরা করে। প্রায়শই দেখতে পাওয়া তাজা পায়ের ছাপ তার প্রমাণ। কচিখালী সৈকতটিও বেশ পরিচ্ছন্ন ও নির্জন।
ডিমের চর
কচিখালী থেকে পূর্ব-দক্ষিণে তাকালে গাছে ভরপুর দূরে যে ছোট্ট দ্বীপটি দেখা যায় তার নাম ডিমের চর। ডিম্বাকৃতি বলেই এর এরূপ নামকরণ। ছোট্ট এ দ্বীপে দেখা যায় নানা রকম পাখি। কয়েক বছর হলো এখানে হরিণেরাও চলে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের চরে বাঘের পায়ের ছাপও দেখেছেন কেউ কেউ। কচিখালী থেকে ইঞ্জিন নৌকায় ডিমের চরে যেতে সময় লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা।
পক্ষীর চর
ডিমের চরের পাশেই জেগে ওঠা ছোট আরেকটি দ্বীপ পক্ষীর চর। সাম্প্রতিক সময়ে পক্ষীর চর ডিমের চরের সাথে একাকার হয়ে গেছে মাঝখানে পলি জমে। এ চরে জেলেদের আনাগোনা বেশি। পক্ষীর চরে দেখা যায় নানা রকম সামুদ্রিক আর পরিযায়ী পাখি। এ চরে আরও দেখা যায় উড়ুক্কু মাছের দলে দলে লাফিয়ে বেড়ানো।
কীভাবে যাবেন
ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুন্দরবনের এসব জায়গাগুলো ভ্রমণে যাওয়া কষ্টসাধ্য। সে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কোনো ভ্রমণ সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। সুন্দরবনে নিয়মিত প্যাকেজ ভ্রমণ পরিচালনা করে থাকে দ্য বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেড। এসব জায়গাগুলোতে বেঙ্গলের চার রাত তিন দিনের নিয়মিত প্যাকেজ রয়েছে। ঢাকা থেকে এসি বাসে খুলনা এবং খুলনা থেকে নিজস্ব লঞ্চে সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখায় তারা। ঢাকা-সুন্দরবন-ঢাকা এ প্যাকেজের বর্তমান মূল্য ১০,৫০০ টাকা। বিদেশিদের জন্য ১২,৫০০ টাকা। যোগাযোগ :দ্য বেঙ্গল ট্যুরস, বাড়ি-৪৫, সড়ক-২৭, ব্লক-এ, বনানী, ঢাকা। ফোন :৮৮৩৪৭১৬, ৮৮৫৭৪২৪।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
কুমিরের ছবিটির আলোকচিত্রী মাসুদ হোসাইন
আচ্ছা আপনার কি মনে হয় না একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এই এমাউন্টটা অনেক বেশি? কোন সংস্থা ছাড়া ব্যাক্তিগত উদ্যোগে যেতে হলে কার কাছ থেকে পারমিশান নিতে হবে? আর কিভাবে যাওয়া যেতে পারে? প্লিজ জানাবেন...আমার যাওয়ার খুব ইচ্ছা সুন্দরবনে...সেখানকার গাছগুলো দেখার জন্য..
ReplyDelete