তৈদু ছড়া। অবাক বিস্ময়ের আশ্চর্য রকম সুন্দর এক জলপ্রপাতের নাম। গত বছর খাগড়াছড়ি জেলার দিঘি নালা উপজেলার তত্কালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মিয়া দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় জলপ্রপাতটির আবিষ্কারক। অদ্ভুত সুন্দর তৈদু ছড়ার সৌন্দর্য বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর হতেই ভ্রমণপিপাসু মন উদগ্রীব হয়ে উঠল। কিন্তু পাহাড়, টিলা, জঙ্গল, ঝিরি পথ ধরে আসা যাওয়া প্রায় বিশ কিলোমিটার। এতটা পথ পাড়ি দিতে পারব কি পারব না এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে ছিলাম।
অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এলো। এবারের দীর্ঘ ছুটিতে ‘দে ছুটের’ দুর্বার গতিসম্পন্ন অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় সাথিদের নিয়ে ছুট দিলাম পাহাড়-অরণ্য ঘেরা জেলা খাগড়াছড়ির পথে। রাত ১১টায় গাবতলী হতে শান্তি পরিবহনে চেপে বসলাম। কমলাপুর এসেই অশান্তির বীজ বপন হলো। বীজ হতে চারা তারপর বিশাল ডালপালা গজিয়ে রামগড়ে এসে যাত্রীদের অশান্তির জলে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিল। চাকার বিয়ারিং বাদ সুতরাং কখন যে মেরামত হয়ে সচল হবে তা আল্লাহই মালুম। তবে ড্রাইভার, হেলপারের মধ্যে মাধুর্যময় আচরণের ঘাটতি ছিলনা। হেলপার একটা চান্দের গাড়ি ঠিক করে দিয়ে অখ্যাত এক বাজারের নাম বাতলে দিয়ে এক গাল হেসে বলল, ‘মামা সেখানে গিয়ে নাস্তা করতে থাকেন, আমরা আপনাদের তুলে নিব।’ কি আর করা, হেলেদুলে গাড়িতে করে পৌঁছলাম বাজারে। নাস্তা পর্ব শেষ হলো কিন্তু গাড়ির দেখা নেই। অগত্যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতিদের সাথে খাগড়াছড়িগামী ট্রাকে চললাম। পাহাড়ি পথে খোলা ট্রাকে ভ্রমণের আনন্দ এতটা যে মজার হবে ভাবতেই পারিনি। পরের দিন সকালে তৈদু ছড়ার অভিযানে বের হয়ে পড়লাম। মাইক্রো স্টার্ট, চলছে দিঘি নালার পোমাং পাড়ার দিকে। একটা সময় গাড়ি আর এগোলো না। প্রয়োজনীয় রসদ (পানি, শুকনা খাবার) নিয়ে হাঁটা শুরু হলো। যাচ্ছি তো যাচ্ছি জলপ্রপাতের দেখা নেই। সমতল পাহাড়, অরণ্য, জুম ক্ষেতের বুক চিরে এগিয়ে চলছি, মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দু-চার জন উপজাতিদের সাথে সাক্ষাত্ হচ্ছে। পাহাড়ের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, জুম চাষের অপরূপ দৃশ্য, সবুজে মোড়ানো চতুর্পাশ আমাদের পথ চলায় শক্তি জুগিয়েছে। এবার দৃষ্টির গোচরে এল পাহাড়ের উপর বসত ঘর। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠলাম। এখানে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসবাস। সাইনবোর্ডে ঝুলছে—বুদ্ধমা পাড়া। সৌহার্দ্যপূর্ণ মানসিকতাসম্পন্ন কয়েকজনের সাথে কথা বলে তৈদু যাওয়ার সঠিক পথ জেনে নিলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার হাঁটা শুরু। তৈদু ছড়া যাওয়ার সবচেয়ে বেশি রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ পথ শুরু হলো। জলপ্রপাতের পানি দিয়ে সৃষ্টি বোয়ালখালি ছড়া দিয়ে যাচ্ছি। দু’পাশে পাথুরে পাহাড়ের গভীর জঙ্গল, পায়ের নিচে ছোট বড় কঙ্কর। কখনো হাঁটু কখনোবা বুক সমান ঠান্ডা শীতল পানি কেটে চলছি। বড় বড় বলাকৃতির পাথরগুলো যেন একেকটি রহস্য। প্রায় এক ঘণ্টা হলো হাঁটছি, জলপ্রপাতের রিমঝিম শব্দ তো দূরে থাক শীতল আবেশও পাচ্ছি না। গাইডদের জিজ্ঞাসা করলাম, আর কত দূর? বলল, এইতো সামনে। সামনে তো আর ফুরায় না। ইতিমধ্যে পিচ্ছিল পথে সবাই কমবেশি চিত্পটাং খেলাম। শরীরের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেও কালাম আমাদের রসনা মিটানোর জন্য চিংড়ি ধরে বোতলজাত করতে ভুল করেনি।
এবার দৃষ্টির সীমানায় এল হাতি। বিশাল দেহ শীতল করার জন্য যেন ডুব দিয়ে আছে। কিন্তু আসলে ওগুলো হাতি না, হাতির আদলে কালো পাথর। কি অদ্ভুদ সৃষ্টি! পরম করুণাময়ের। আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর কানে ভেসে এলো পানি পড়ার শব্দ। হিম হিম ঠান্ডা অনুভূত হলো। দশ মিনিট হাঁটার পর চোখ আটকালো।
ওয়াও! এ কোন জগত্? এটা কি আমার সোনার বাংলায় না কি অন্য কোনোখানে। ৬০-৭০ ফিট উপর হতে অবিরাম ধারায় গড়িয়ে পড়া জলরাশি দেখে নিমেষেই মিলিয়ে গেল সব ক্লান্তি। নব উদ্যমে ঝরণার উপর হতে অবিরাম ধারায় গড়িয়ে পড়া জলরাশি দেখে নিমেষেই মিলিয়ে গেল সব ক্লান্তি। নব্যোদমে ঝরনার পানিতে বেশ কিছুক্ষণ শরীর ভিজালাম। ইতিমধ্যে চিংড়ির বারবিকিউ পরম স্বাদে খাওয়া হলো। দেহ ইঞ্জিন এখন পুরোপুরি ফিট। দেখতে হবে দ্বিতীয় ঝরনাটি। আবিষ্কারক নিজেই যেখানে যেতে পারেনি। কিন্তু স্বভাব সুলভভাবে বেঁকে বসল কচি, তার সাথে যোগ দিল নাদুস-নুদুস রবিন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, জীবন দেবো তবুও ‘দে ছুটের’ মান বিসর্জন হতে দেবো না। ‘দে ছুট’ মানেই হলো অ্যাডভেঞ্চার। অদেখাকে দেখার জয় সুতরাং আবারও ঘণ্টাখানেক পথ পরিক্রম।
লাঠি, বাঁশে ভর করে গুহা, পাহাড়, জঙ্গল ঝিরির পিচ্ছিল পাথর মাড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছি। কে যে কতবার চিত্পটাং হয়েছি গুণেও বলতে পারব না। প্রথমটিতে আসার সময় স্থানীয় কিছু পর্যটকদের সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু এখন এই মৃত্যু উপত্যকায় শুধুই আমার, আর ভ্রমণের আনন্দ ঠিক এখানেই। মৃত্যু উপত্যকা বলতে বুঝিয়েছি, একটু বেখেয়াল হলেই চরম দুর্ঘটনা বা মৃত্যু। তবে হায়াত্ থাকা পর্যন্ত কারো মৃত্যু নেই। সুতরাং ভ্রমণের অপূর্ণতাও থাকা ঠিক নয়। ঝরনার পানির কল কল শব্দ কানে ভেসে এলো। সবাই চিত্কার দিয়ে উঠলাম পেয়ে গেছি।
কি অপূর্ব সুন্দর! প্রায় ৩০০ ফিট উপর থেকে বিশাল জলরাশি বেয়ে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে দু’চোখ অপলক হয়ে রইল। আল্লাহ্ যেন স্বয়ং তার মহিমান্বিত নিদর্শন ছড়িয়ে দিয়েছে। পর্যটকদের জন্য রয়েছে অপার সৌন্দর্যের হাতছানি। তৈদু ছড়ার প্রথম ঝরনাটির চাইতে বহু বহু গুণে বেশি নয়নাভিরাম দ্বিতীয়টি। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে আকৃতিতে বড় ও আকর্ষণীয় জলপ্রপাত হলো ‘তৈদু ছড়া’। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি তৈদু ছড়া যাওয়ার জন্য যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলত তাহলে দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরা এসেও দেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করত। মন মাতানো ঝরনার রূপে মজে গিয়ে সময় জ্ঞান ভুলে দীর্ঘক্ষণ ভিজলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন চার। কিন্তু গভীর অরণ্যঘেরা হওয়া যেন সন্ধ্যা। বিদায় নৈসর্গের রানি তৈদু। আসার সময় বেশির ভাগ উপর দিকে উঠতে হয়েছে, এখন নিচের দিকে। ডানে গভীর গিরি খাত, বামে উঁচু পাহাড় আর সামনে বড় বড় পিচ্ছিল বোল্ডার, কখনো পানির তীব্র গতি। এক পর্যায় ভয়ঙ্কর সময় এসে হাজির, এক পাহাড় হতে আরেক পাহাড়ে গাছের গুড়ির উপর দিয়ে যেতে হবে। আসার সময় তালে তালে জয়ের নেশায় গিয়েছিলাম কিন্তু ফেরার সময় চোখ পড়ল ডানে গভীর গিরি খাতের দিকে, পা পিছলে পড়লেই জীবন লীলা সাঙ্গ। বুদ্ধুমা পাড়ায় যখন এসে হাজির হলাম। বুদ্ধমা পাড়ায় জুম চাউলের ভাত আর পাহাড়ি মোরগের ভুনা গোসত্ দিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। এই পর্যন্ত ‘দে ছুট’ যতগুলো ভ্রমণে গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অ্যাডভেঞ্চার পূর্ণ ভ্রমণ হলো ‘তৈদু ছড়া’। জানি না আগামীতে এর চেয়েও বড় কোনো রহস্যময় স্থানে ভ্রমণ অপেক্ষা করছে কি না। খাগড়াছড়ি ভ্রমণে আরও যা দেখবেন আলুটিলা গুহা, রি-সাং ঝরনা, দেবতার পুকুর এবং শান্তিপুর অরণ্য কুটির। খরচ জন প্রতি চার হাজার টাকা মাত্র। পাহাড়-অরণ্য ঘেরা দুর্গম তৈদুর পথে ভ্রমণ করুন নির্ভয়ে।
লেখক: মো. জাভেদ হাকিম
No comments:
Post a Comment