Pages

Friday, July 27, 2012

কবিগুরুর স্মৃতির পানে


Details
গত ২৫ বৈশাখ ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে কবির স্মৃতিধন্য অনেক জায়গা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য অনেক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি এসব জায়গাতেই। বৈশাখ শেষে চলুন ঘুরে আসি এসব জায়গা থেকে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
জেলা সদর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ি। শিলাইদহের আগে নাম ছিল খোরশেদপুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার গ্রামটি কিনে নেওয়ার আগে এখানে একটি নীলকুঠি ছিল। শেলী নামে একজন নীলকর এটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। গড়াই এবং পদ্মা নদীর মিলিত প্রবাহের ফলে গভীর একটি ‘দহ’ বা ঘূর্ণিস্রোত থেকে গ্রামটির নাম হয় শেলীদহ। পরবর্তীতে তা রূপ নেয় শিলাইদহ-তে। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইল সূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিকানা পান। জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে। কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন সময় জমিদারি দেখাশোনা করতে কবি এখানে আসতেন এবং কুঠিবাড়িতেই থাকতেন। একসময় পদ্মার ভাঙন কুঠিবাড়িকে গ্রাস করার উপক্রম হলে বাড়িটি ভেঙে নতুন কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১-১৯০১ সালে অল্প বিরতিতে কবি নিয়মিত এখানে অবস্থান করেছেন। শিলাইদহে অবস্থানকালে কবি তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি লাভ করেছিলেন। ১৯১৩ সালে কবি যে সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, সেই ‘গীতাঞ্জলি’র অধিকাংশ কবিতাই শিলাইদহে রচিত। এ ছাড়াও জায়গাটিতে বসে বসে তিনি অসংখ্য গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গান ইত্যাদি রচনা করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘সোনারতরী’, ‘ক্ষণিকা’, ‘কথা ও কাহিনি’, ‘বলাকা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘চিরকুমারসভা’, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘বলাকা’, ‘পঞ্চভূতের ডায়েরি’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চোখের বালি’ ইত্যাদি।
সবুজে ঘেরা এ কুঠিবাড়ির প্রবেশপথেই রয়েছে লোহার ফটক। চারপাশ মোটা দেয়ালে ঘেরা। ভেতরে তিনতলা বিশিষ্ট কুঠিবাড়ি। প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ বাড়িটিতে সবমিলিয়ে পনেরটি কক্ষ আছে। তিন তলার একটি ঘরে বসে পদ্মার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবি তার শিল্পকর্ম রচনা করতেন। এখানে রয়েছে বেশ কিছু তৈলচিত্র, কবির ব্যবহূত লেখার টেবিল, নৌকা, আরামকেদারা, আলমারি, পালকি, ঘাসকাটার যন্ত্র ইত্যাদি।  কবি যে নৌকাটিতে চড়ে পদ্মায় ভেসে লিখেতেন গল্প-কবিতা, সেটিরও ধ্বংসাবশেষ দেখা যাবে কুঠিবাড়িতে। এ ছাড়াও কুঠিবাড়ির পূর্বপাশে আছে কবির আম বাগান, পশ্চিম পাশে শান বাঁধানো পুকুর। 
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাদুঘর। সপ্তাহের রবি ও সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর। সোমবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ২৫ বৈশাখ কবির জন্মবার্ষিকী এবং ২২ শ্রাবণ মৃত্যুবার্ষিকীতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় শিলাইদহে।
যাতায়াত ও থাকা
ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কপথে কুষ্টিয়া যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী কল্যাণপুর থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস বি পরিবহন, কেয়া পরিবহন, রেজিনা পরিবহন, ইত্যাদি বাস চলে এ পথে। ভাড়া ৩৫০-৪০০ টাকা।  কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ যেতে পারেন বাস কিংবা টেম্পোতে চড়ে।
কুষ্টিয়া শহরে থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল হলো—হোটেল রিভারভিউ (০৭১- ৭১৬৬০, কক্ষ ভাড়া ৩০০-১২০০ টাকা), ফেয়ার রেস্ট হাউস (০৭১-৬১৪৭০, কক্ষ ভাড়া  ১৫০-৬০০ টাকা ), হোটেল গোল্ডস্টার (০৭১- ৬১৬৭৫, কক্ষ ভাড়া ১২০-৮০০ টাকা), হোটেল আজমিরী (০৭১- ৬১১১৯৩, কক্ষ ভাড়া ৮০-৪৫০ টাকা),  হোটেল পদ্মা (০৭১- ৭৩৬৭৮, কক্ষ ভাড়া ১০০-৫০০ টাকা) ইত্যাদি।
শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কাচারিবাড়ি। এখানেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক জমিদারি ছিল। কবির দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকরদের একটি কুঠি নিলামে কিনে নেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে সর্বপ্রথম শাহজাদপুরে জমিদারি তত্ত্বাবধান করতে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপরে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত জমিদারির কাজে এখানে যাওয়া-আসা ও অবস্থান করেন কবি। এখানে অবস্থানকালে তিনি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগির ফলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় রবীন্দ্রনাথের অন্য শরীকদের কাছে। তাই ১৮৯৬ সালে তিনি শাহজাদপুর ছেড়ে চলে যান। জমিদারি খাজনা আদায়ের একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন এখনো আছে, বর্তমানে যা ব্যবহূত হচ্ছে জাদুঘর হিসেবে। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্ম দিবসে এখানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তিন দিনের নানান অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়।
যাতায়াত ও থাকা
ঢাকার গাবতলী থেকে শাহজাদপুর এক্সপ্রেস সরাসরি যায় শাহজাদপুর। এ ছাড়াও ঢাকার মহাখালী থেকে সৌরভ পরিবহন, এস আই এন্টারপ্রাইজ, গাবতলী থেকে ইউনিক সার্ভিসের বাস যায় সিরাজগঞ্জ। জেলা শহর থেকে রবীন্দ্র কাচারিবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সেখান থেকে বাসে শাহজাদপুর স্টেশনে নেমে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাচারিবাড়ি।
সিরাজগঞ্জ শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হলো শহরের স্বাধীনতা স্কোয়ারে হোটেল আল হামরা, (০৭৫১-৬৪৪১১, ০১৭৪৫৬২৯২৬৪, এসি এক শয্যা কক্ষ ৫০০ টাকা, এসি দ্বিশয্যা  ৭০০ টাকা, নন এসি এক শয্যা কক্ষ ৪৫০, নন এসি দ্বিশয্যা কক্ষ ২৫০ টাকা)। শেখ মুজিব রোড হোটেল অনিক (০৭৫১-৬২৪৪২, ০১৭২১৭১৯২৩৫, এসি এক শয্যা কক্ষ ৪৫০ টাকা, এসি দ্বিশয্যা  ৭০০ টাকা, নন এসি এক শয্যা কক্ষ ১৫০, নন এসি দ্বিশয্যা কক্ষ ২৫০ টাকা)। এ ছাড়া শাহজাদপুরেও সাধারণ মানের হোটেল হলো শাহজাদপুর হোটেল, হোটেল মোহনা, হোটেল সিরাজ। এসব হোটেলে সস্তায় থাকার ব্যবস্থা আছে।
পতিসর কুঠিবাড়ি
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি কুঠিবাড়ি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগনার সদর কাচারি ছিল এখানে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে এ জমিদারি ক্রয় করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন।
পতিসরের দোতলা কুঠিবাড়ি অনেকটা শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িরর অনুরূপ। বাড়ির সামনের প্রশ্বস্ত খোলা মাঠ নাগর নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯০৫ সালে তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কারের এক লক্ষ টাকাও তিনি এই ব্যাংককে দন করেন। ১৯১৩ সালে কবি পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন সময়ে এখানে অবস্থানকালে কবি রচনা করেন তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্যকর্ম। ১৯২১ সালে জমিদারি ভাগ হলে পতিসর রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে। কিন্তু নানান ব্যস্ততার কারণে পতিসরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। শেষ বারের মতো তিনি পতিসরে আসেন ১৯৩৭ সালে। রবীন্দ্র কাচারিবাড়িতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে কবির অনেক স্মৃতিময় নিদর্শন। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্মদিনে এখানে নানান অনুষ্ঠান এবং লোকজ মেলা চলে আসছে বহু বছর ধরে।
যাতায়াত ও থাকা
ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি নওগাঁ যায় শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস আর পরিবহন, কেয়া পরিবহন, বাবলু পরিবহন, টি আর সার্ভিস। ভাড়া ২৫০-৩৫০ টাকা। নওগাঁ সদর থেকে পতিসর আসা যায় বাসে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা। 
নওগাঁ শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কয়েকটি হোটেল হলো সান্তাহার রোডে হোটেল অবকাশ (০৭৪১-৬২৩৫৬), সান্তাহার রোডে হোটেল ফারিয়াল (০৭৪১-৬২৭৬৫), মুক্তির মোড়ে হোটেল আগমনী (০৭৪১-৬৩৩৫১), শহরের পাড়-নওগাঁ এলাকায় হোটেল যমুনা (০৭৪১-৬২৬৭৪), পুরনো বাস স্টেশনে হোটেল স্মরণী (০৭৪১-৬১৬৮৫)। এসব হোটেলে ৮০-৪০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।

লেখক: লেখা মোস্তাফিজুর রহমান  |  শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১২, ১২ শ্রাবণ ১৪১৯
ছবি কে এম আসাদ ও শেখ কবিরুল হাসান

No comments:

Post a Comment