নিলক্ষ্যা। কী সুন্দর নাম! বন্ধুর কাছে নাম শুনেই জায়গাটিতে যাবার ইচ্ছা জাগে। ঢাকা থেকে বেশি দূরেও নয়, নরসিংদীর রায়পুরায়। গত বছরের কোনো এক শুক্রবারে ঢাকার জয়কালী মন্দির থেকে ন্যাশনাল পরিবহনের এসি বাসে উঠে পড়ি। ছুটির দিন বলে মহাসড়কে ব্যস্ততা থাকলেও যানজট ছিল না। দু’ঘণ্টার মাথায়ই আমার বাসের চাকা তাই নরসিংদীর মাটি ছোঁয়। বাস থেকে নেমে পরবর্তী বাহনের খোঁজে নামি। গন্তব্য রায়পুরা।
আমার সামনে তিন ধরনের বাহন। টেম্পু, বেবি ট্যাক্সি আর রিকশা। টেম্পুর কান ফাটানো শব্দ, বদ্ধ বেবি টেক্সি। তাই সময় বেশি লাগলেও রিকশাকেই বেছে নিলাম। নরসিংদী শহর ফেলে রিকশা যতই সামনে যায়, ধীরে ধীরে রায়পুরাও যেন তার সৌন্দর্য প্রকাশে ব্যাকুল হয়। পিচে ঢাকা আঁকাবাঁকা সরু সড়ক। দুই পাশে দিগন্ত জোড়া সবুজ সবজি ক্ষেত। চলতে চলতে একসময় এসে চোখ আটকে যায় নীল জলে ভরা নিলক্ষ্যা বিলে। উপরে নীল আকাশ, নিচে স্বচ্ছ জলে ভরা বিল।
নিলক্ষ্যায় মানুষের আনাগোনা খুবই কম। নেই বললেই চলে। শুধু দেখা মিলবে নৌকায় চুপচাপ বসে বড়শিতে মাছ ধরে যাওয়া কিছু জেলেদের। বিকেলে অবশ্য কিছু দর্শনার্থীও আসেন বিলটির সৌন্দর্য দেখতে। দুইপাশে বিল, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সড়ক। দেখলে মনে হতে পারে সড়কটিকে বিলের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিলক্ষ্যায় এসে রিকশা থেকে নামলাম। দূর থেকে ডেকে আনলাম এক জেলে নৌকা। মাছ ধরায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ৫০ টাকা ঘণ্টায় তার ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাটি নিয়ে নিলাম। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ জেলের নাম আব্দুল হাকিম। তার কথায় জানা গেল অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ ভালোই মাছ ধরা পড়েছে তার হাতে। তাই আমাদের বেড়ানোর সুযোগটা দিলেন তিনি। এ ছাড়া সারাদিন মাছ ধরতে ধরতে একঘেঁয়ে লাগছিল তার।
হাকিম চাচা নিলক্ষ্যা বিলের চারিদিকে ঘুরালেন তার ছোট্ট নৌকাটি নিয়ে। বিলের মধ্যে চলতে চলতে নৌকাটি নিয়ে চলে এলেন গ্রামের দিকটাতে। গামগুলোর চারপাশে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকা পাট ক্ষেত আর পাট ক্ষেত।
দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। সঙ্গে আনা খাবারগুলো নৌকাতেই খেয়ে নিলাম। এদিকে হাকিম চাচা খবর দিলেন সামনেই মেঘনা নদী। এখন গেলে নানা রকম মাছ পাওয়া যাবে মেঘনার ঘাটে। নৌকা থেকে নেমে রিকশা নিয়ে চললাম তাই মেঘনার দিকে। বেশি সময় চলতে হলো না। আমরা সারাদিন তো মেঘনার কাছেই ছিলাম! সামনেই পেয়ে গেলাম বেশ কয়েকজন জেলেকে। সবাই জাল টানতে ব্যস্ত। বিশাল এলকাজুড়ে জাল ফেলে এখন টানা হচ্ছে। একজন জেলের কাছ থেকে জানা গেল এ জালটির নাম ‘জগেবড়’। বিশাল আয়তনের জাল বলেই মনে হয় এ রকম নামকরণ। পুরো জালটি ওঠানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম সেখানে।
আনন্দে কাটানো সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চািমাকাশমুখী হচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই নরসিংদী পৌঁছানোর কথা ভেবে রিকশার প্যাডেলে পা রাখল চালক। আবার সেই রায়পুরার সবুজ সবজি ক্ষেত দেখতে দেখতে চললাম ব্যস্ত এক নগরের দিকে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়কপথে ৫২ কিলোমিটার এবং রেলপথে ৫৭ কিলোমিটার দূরে নরসিংদী জেলা শহর। সড়ক ও রেলপথে আসা যায় এ শহরে। ঢাকার গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির ও সায়দাবাদ হতে নরসিংদীর বাসগুলো ছাড়ে। ভাড়া ৫০-৮০টাকা। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের যে কোনো রুটের বাস নরসিংদী হয়ে যাতায়াত করে। এসব বাসে করেও সহজেই নরসিংদী আসা যায়। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর এক্সপ্রেস, ব্রাহ্মণবাড়ীয়াগামী তিতাস কমিউটার এবং কিশোরগঞ্জগামী এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসে যাওয়া যায় নরসিংদী। সেখান থেকে টেম্পুতে, বেবি টেক্সি করে আসতে হবে রায়পুরা। রায়পুরা থেকে রিকশায় নীলক্ষ্যা বিলে যেতে সময় লাগে ত্রিশ মিনিট। তবে নরসিংদী থেকে পুরো যাত্রাটিই রিকশায় গেলে উপভোগ্য হবে। সে ক্ষেত্রে সময় অনেক বেশি লাগবে। নরসিংদী থেকে সারাদিনের জন্য একটি রিকশার ভাড়া পড়বে ৫০০-৬০০ টাকা।
সতর্কতা
যারা সাঁতার জানেন না তারা নিলক্ষ্যা বিলে ভ্রমণে গেলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেবেন। নৌকায় ভ্রমণকালে হৈচৈ, লাফালাফি করবেন না। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
No comments:
Post a Comment