Pages

Friday, July 27, 2012

আম খেতে চাঁপাই


Details
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয় উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। জায়গাটি তাই আমের রাজধানী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেছে। এ জেলার সর্বত্রই এখন পাকা আমের মৌ মৌ ঘ্রাণ। এ ছাড়াও প্রাচীন গৌড়ের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনাও রয়েছে এ জেলার বিভিন্ন জায়গায়। আমের এ ভরা মৌসুমে চলুন ঘুরে আসি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।
থানা ঘাট আম বাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের এক পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী। এ সময়ে শহরের থানা ঘাটে প্রতিদিন সকাল বেলা দূরদূরান্ত থেকে আম বোঝাই অনেক নৌকা ভিড় জমায়। খুব ভোরে শুরু হয়ে এ বাজার বেলা ওঠার কিছু পরেই শেষ হয়ে যায়। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের ভেতরেই আছে বেশ কয়েকটি বড় বড় আম বাগান। এগুলোও ঘুরে দেখতে পারেন।
কানসাট আম বাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দূরদূরান্ত থেকে সাইকেল কিংবা রিকশা ভ্যানে করে আম নিয়ে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকেন আমচাষিরা। আমের সময়ে প্রতিদিন এখানে হাট বসে।
ভোলাহাট আম বাজার
এ অঞ্চলের আরেকটি বড় আমের হাট ভোলাহাট। সীমান্তবর্তী এ বাজারটিতেও এ সময়ে প্রচুর আমের সমাগম ঘটে। এ বাজারটিও ঘুরে দেখতে পারেন। 
আম বাগান
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ফেলে মহানন্দা সেতু পেরিয়ে সোনা মসজিদ স্থল বন্দরের সড়ক ধরে চললে দু’পাশে শুধুই আম বাগান। এ জায়গার বেশিরভাগ আম বাগানই বেশ পুরোনো। বাগান মালিকের অনুমতি নিয়ে যেকোনো বাগোনে নেমেই ঘুরে দেখতে পারেন, তবে গাছ থেকে কোনোভাবেই আম পারা যাবে না কিন্তু!
ছোট সোনা মসজিদ
তাহ্খানা থেকে পূর্ব পাশে প্রধান সড়ক লাগোয়া অবস্থিত সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোটসোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তার রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত। মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে। যার একটিতে সমাহিত আছেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
তাহ্খানা
সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে বিশাল একটি দিঘির পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্ব দক্ষিণেরটি হলো তাহখানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহশুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারও কারও মতে, শাহশুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ
তাহ্খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটির পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙ্গিনার চার পাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদটির পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদটি নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগ দখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি
মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গা জুড়ে সমাধি এলাকার বেষ্টনি প্রাচীর। দক্ষিণ দেয়ালে আছে প্রবেশপথ। এখান থেকে পাকা পথ ধরে কিছুটা সামনেই সমাধি সৌধ। সৌধটির চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশকিছু কবর। দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে, ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহশুজা তখন বাংলার সুবাদার। শাহশুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান।
কোতোয়ালী দরওয়াজা
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশ পথটিই কোতওয়াল দরজা। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়াল-এর অনুকরণে এর নামকরণ হয়। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশ পথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলো দিয়ে শত্রুর ওপরে গুলি কিংবা তীর ছোড়া হতো বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কোতোয়ালী দরওয়াজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।
খনিয়াদিঘি মসজিদ
সোনামসজিদ স্থল বন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে  আম বাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত মসজিদটি। ইটের তৈরি এ মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। প্রার্থনা কক্ষের ঠিক ওপরে বিশাল আকারের এ গম্বুজটির অবস্থান। মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষের বাইরে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা।
পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মূল মিহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটা আচ্ছাদিত ছিল। যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান।
খনিয়াদিঘি মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যিক রীতির বিচারে ঐতিহাসিকগণ এটিকে পরবর্তী ইলিয়াস ইলিয়ামশাহী আমলে ১৪৮০ সালের দিকে নির্মিত বলে মনে করেন।  মসজিদের পূর্ব দিকেই রয়েছে রয়েছে প্রাচীন আমলের খনিয়াদিঘি। এ কারণেই এর এরূপ নামকরণ। তবে এ মসজিদের অন্য একটি নাম হলো রাজবিবি মসজিদ।
কীভাবে যাবেন
রাজধানী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দূরত্ব ৩১৭ কিলোমিটার।
রাজধানী থেকে সরাসরি সড়কপথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। এ পথের বাস সার্ভিস হলো—মডার্ন এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, লতা পরিবহন, দূরদূরান্ত পরিবহন ইত্যাদি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করে এ পথের বাসগুলো। ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাবার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা। 
কোথায় থাকবেন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তি মোড়ে হোটেল আল নাহিদ (০৭৮১-৫৫৭০১-৩, ০১৭১৩৩৭৬৯০২), আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), লাখেরাজপাড়ায় হোটেল রাজ (০৭৮১-৫৬১৯৩), একই এলাকায় হোটেল রংধনু (০৭৮১-৫৫৮০৭)। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু হোটেল আছে এ শহরে। এসব হোটেলে ২০০-১০০০ টাকায় অবস্থান করা যাবে।

লেখক: আলোকচিত্র ও লেখা :মুস্তাফিজ মামুন  |  শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১২, ১২ শ্রাবণ ১৪১৯

No comments:

Post a Comment