বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ জলাভূমির নাম চলনবিল। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিস্তৃত অংশজুড়ে এ বিলের অবস্থান। শুকনো মৌসুমে বিলের আয়তন অনেক কমে গেলেও তা প্রাণ ফিরে পায় বর্ষায়। এই মৌসুমে তাই চলনবিল হতে পারে উপযুক্ত ভ্রমণ গন্তব্য।
চলনবিল তথ্য
ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময় চলনবিলের সৃষ্টি। গঠিত হবার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১, ০৮৮ বর্গকিলোমিটার। তবে বর্তমানে এর আয়ন অনেক কমে এসেছে। চলনবিল মূলত অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষায় এই বিলগুলোতে জলপ্রবাহ বেড়ে একসঙ্গে বিশাল এক বিলের সৃষ্টি হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ, পাবনা জেলার চাটমোহর এবং নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলাজুড়ে এ বিলের বিস্তৃতি। বিলটির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পাবনা জেলার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর প্রশস্ততম দিকটি উত্তর-পূর্ব কোনাকুনি। নাটোরের সিংড়া থেকে গুমনী পাড়ের কচিকাটা পর্যন্ত এ বিলের দীর্ঘতম অংশ প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ। নাটোরের সিংড়ার পূর্বপ্রান্ত থেকে পাবনার তাড়াস উপজেলার ভদাই নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত বিলের পূর্ব সীমানা।
নাটোরের চলনবিল
চলনবিলের সবচেয়ে বড় অংশ পড়েছে নাটোরে। জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের বড় একটি অংশ। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়ুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের ওপর দিয়েই। সড়কের দুপাশে এ সময়ে যেদিকে চোখ যায় শুধু অথৈ জলরাশি। এ পথে চলতে চলতে সড়কের দু’পাশে চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় দু’চোখ ভরে। নিজস্ব গাড়িতে গেলে ইচ্ছামতো থেমে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব। এ ছাড়া চলনবিলের আকর্ষণীয় একটি বিল হাইতি বিল নলডঙ্গা উপজেলায়। জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ বিলের অবস্থান। এ বিলটিকে দেশের সবচেয়ে গভীর বিল বলা হয়। প্রায় বারো মিটার গভীর এ বিলে সারা বছরই পানি থাকে। তবে বর্ষায় পানির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক বেশি।
চলনবিল জাদুঘর
জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে আছে চলনবিল জাদুঘর। স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ বাড়িতে ১৯৭৮ সালে গড়ে তুলেছেন বিচিত্র এ জাদুঘর। চলনবিলে প্রাপ্ত নানান নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম ছাড়াও এখানে আছে অনেক দুর্লভ সংগ্রহ। নাটোর থেকে বাসে গুরুদাসপুর উপজেলায় এসে সেখান থেকে নদী পার হয়ে রিকশায় আসা যাবে খুবজিপুর গ্রামের এ জাদুঘরে। শনিবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
যাতায়াত ও থাকা :ঢাকার গাবতলি থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ন্যাশনাল পরিবহন প্রভৃতি বাসে যাওয়া যায় নাটোর। এ ছাড়া রাজশাহীগামী যেকোনো বাসেই নাটোর আসা সম্ভব। ভাড়া ২৫০-৪০০ টাকা। নাটোরর চলনবিল দেখতে গেলে থাকতে হবে নাটোর জেলা সদরে। এ শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের চকরামপুরে হোটেল ভিআইপি (০৭৭১-৬৬০৯৭, নন এসি কক্ষ ১০০-২০০ টাকা), মাদ্রাসা রোডে হোটেল উত্তরা (০৭৭১-৬২৫১৯, নন এসি কক্ষ ১০০ টাকা), মাদ্রাসা মোড়ে হোটেল মিল্লাত (০৭৭১-৬১০৬৫, নন এসি কক্ষ ১৮০ টাকা), কানাইখালীতে হোটেল আরপি (০৭৭১-৬২৫৭৯, নন এসি কক্ষ ১৭০ টাকা)।
সিরাজগঞ্জের চলনবিল
জেলার রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলার বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে চলনবিলের অংশ বিশেষ। চলনবিলের বেশ কয়েকটি বিল পড়েছে এ উপজেলা দুটিতে। বর্ষায় বেড়াতে এলে চলন বিলের এসব জায়গায় বেড়ানো যেতে পারে।
যাতায়াত ও থাকা :ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ আসা যায় সড়ক ও রেল পথে। ঢাকার মহাখালী থেকে সৌরভ পরিবহন (০১১৯৯১২২৩৪৫), এস আই এন্টারপ্রাইজ (০১৭১২৬৭৮৬৪৯), গাবতলী থেকে ইউনিক সার্ভিস (০১১৯০৮০৬৪৭৭) ইত্যাদি পরিবহনের বাস যায় সিরাজগঞ্জ। ভাড়া ১৭০ টাকা। সিরাজগঞ্জ থেকে রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলায় আসা যাবে লোকাল বাসে। সিরাজগঞ্জ শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হলো শহরের স্বাধীনতা স্কোয়ারে হোটেল আল হামরা, (০৭৫১-৬৪৪১১, ০১৭৪৫৬২৯২৬৪, এসি এক শয্যা কক্ষ ৫০০ টাকা, এসি দ্বিশয্যা ৭০০ টাকা, নন এসি এক শয্যা কক্ষ ৪৫০, নন এসি দ্বিশয্যা কক্ষ ২৫০ টাকা)। এক শয্যা কক্ষ ১৫০, নন এসি দ্বিশয্যা কক্ষ ২৫০ টাকা)।
পাবনার চলনবিল
চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চলনবিলের অংশ। গাজনা বিল, নড়বিল, সোনাপাতিলা বিল, ঘুঘুদহ বিল, চিরল বিল ও গুরকা বিল ইত্যাদি বড় আকারের বিলগুলো বেশিরভাগই পাবনা জেলায়। বড়বিলের আয়তন প্রায় ৩১ বর্গ কিলোমিটার ও সোনাপাতিলা বিলের আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া এ বিলের আরও দুটি বৃহত্ অংশ যথাক্রমে ১৮ ও ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুরলিয়া ও দিক্ষি বিল চাটমোহরে অবস্থিত। বর্ষায় এ বিল থাকে জলে পরিপূর্ণ। এ সময়ে বিলে বেড়াতে ভালো লাগবে সবার। জেলা সদর থেকে বাসে চাটমোহর এসে সেখান থেকে রিকশায় আসা যায় চলনবিলে।
যাতায়াত ও থাকা :ঢাকা থেকে সরাসরি পাবনা যাওয়া যায় সড়কপথে। প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার বাস চলাচল করে এ পথে। পাবনা এক্সপ্রেস (০১৭১১০২৪০৮৮), শ্যামলী পরিবহন, রাজা বাদশা পরিবহন (০১৭১৬৩০৭৫২০), কিংস পরিবহন (০১৭১১৪৮০৩১৫), বাদল গ্রান্ড চয়েজ (০১৬৭১৬৪০৬৪২), সরকার ট্রাভেলস (০১৭২৫৪৪২৬৪৬)। এসব পরিবহনের সাধারণ চেয়ার কোচ চলে এ পথে। ভাড়া ২৫০ টাকা। পাবানা শহরে রাত্রিযাপন করার জন্য ভালো মানের হোটেল হলো শহরের শহরের জালালপুরে প্রশান্তি ভুবন পার্ক (০১৭১২৮৮৫৭৮২, এসি কক্ষ ১২০০-১৫০০, সাধারণ কক্ষ ৮০০ টাকা), হোটেল পার্ক (০১১৯৭০৮৩৩০১, এসি কক্ষ ৬০০-২৫০, সাধারণ কক্ষ ৮০০ টাকা), হোটেল শীল্টন (০১৭১২৪৩৩২৫০, এসি কক্ষ ৭০০, সাধারণ কক্ষ ২০০-৩০০ টাকা) ইত্যাদি।
কীভাবে বেড়াবেন :চলনবিলে বেড়ানোর জন্য স্থানীয় নৌকা পাওয়া যাবে ভাড়ায়। সারা দিনের জন্য ভালো মানের একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ৫০০-৮০০ টাকা। এ ছাড়া ইঞ্জিন নৌকা মিলবে ১০০০-২০০০ টাকায়। তবে চলনবিলে বেড়ানোর জন্য সাধারণ নৌকাই ভালো। কারণ, ইঞ্জিন বোটের শব্দ আপনার বিরক্তির কারণ হতে পারে।
সতর্কতা :যারা সাঁতার জানেন না, তারা চলনবিলে ভ্রমণে গেলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেবেন। নৌকায় ভ্রমণকালে হৈচৈ, লাফালাফি করবেন না। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।
আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ
No comments:
Post a Comment