Pages

Friday, July 27, 2012

জাদুকাটার তীরে

Details
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শীতল ধারায় বয়ে আসা শান্ত স্নিগ্ধ নদীটির নাম যাদুকাটা। সত্যিই এর রূপে যাদু খুঁজে পাবেন প্রকৃতিপাগল সবাই। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী এ জায়গাটির এক পাশে সুউচ্চ টিলাটির নাম বারেকের টিলা। টিলার উপরে দাঁড়ালে, দৃষ্টি যতদূর যায়, চোখের সামনে শুধু যাদুকাটার সৌন্দর্য। শত শত নৌকা ভেসে বেড়ায় শীতল জলের সুন্দর এ নদীর বুকে। জলের গভীরতা বর্ষায় একটু বেশি থাকলেও শীতে শুকিয়ে কোথাও কোথাও থাকে হাঁটু জল। টলটলে স্বচ্ছ জল এ নদীর। নিচের বালুকণায় সূর্য কিরণ হিরা-মুক্তার মতো মনে হয়।  সারা বছরই শ্রমজীবী মানুষেরা নদীর তলা থেকে তুলে নিয়ে আসেন পাথর আর বালু।
শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা। সব ঋতুতেই জায়গাটিতে বেড়ানোর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পাবেন পর্যটকরা। একদিকে ভারত সীমান্তে আকাশ ছোঁয়া সবুজ শ্যামল পাহাড়, এর নিচে উঁচু নিচু টিলা, আরেক পাশ দিয়ে বয়ে চলা জাদুকাটার জলধারা। জায়গাটিকে অনেকে বলে থাকেন সুনামগঞ্জের আইফেল টাওয়ার। নামটা যারই দেয়া হোক না কেন, এর যথার্থতা খুঁজে পাবেন যে কেউ। বারিকের টিলার চূড়ায় দাঁড়ালে চারদিকের সৌন্দর্য এসে সহজেই চোখে ধরা দেয়। টিলাটির শরীর জুড়ে সবুজ গাছগাছালির সমারোহ। মাঝখান দিয়ে কুচকুচে কালো একটি সরু পিচ ঢালা পথ উঠে গেছে উপরে। জাদুকাটার তীর থেকে। উপরে আছে আদিবাসীদের দুটি পাড়া। একটি গির্জাও দেখা যাবে এখানে। বারেকের টিলার উপরেই সীমানা পিলার। সামনেই নো ম্যানস ল্যান্ড। 
মেঘালয় রাজ্যের উঁচু দুই পাহাড়ে ভেঙে মাঝখান দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে যাদুকাটা। জনশ্রুতি আছে একদা এই জাদুকাটার তীর ঘেঁষেই ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে রাজ্য, নেই তাই রাজধানীও। এলাকার নামের সঙ্গে এখনো জড়িয়ে আছে শুধুই রাজ্যের নামটি, ‘লাউরেরগড়’।
মাঝখানে জাদুকাটা নদী। পূর্বে লাউরের গড় গ্রাম। এখানেই শাহ আরেফিনের (রহ.) আস্তানা। আর নদীটির পশ্চিম পাড়ে বারেকের টিলা। লাউরেরগড়  গ্রামের দক্ষিণ পাশটায় নদীতীরে আছে হিন্দু ধর্মানুসারীদের একটি তীর্থস্থান। প্রতিবছর চৈত্র মাসে প্রায় একই সময়ে শাহ আরেফিনের (রহ.) দরগায় বসে ওরস, আর জাদুকাটা তীর্থে বসে হিন্দুদের পুণ্যস্নান, নাম তার পনাতীর্থ। এ দুই উত্সব ঘিরে সে সময়ে হিন্দু-মুসলমানের অসামপ্রদায়িক মিলনমেলা বসে জাদুকাটার তীরে। এখানকার পুণ্যস্নান নিয়ে হিন্দু পুণ্যার্থীদের আছে এক বিশ্বাস। হিন্দু ধর্মের সাধক পুরুষ অদৈত মহাপ্রভুর মা লাভা দেবীর গঙ্গা স্নানের খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে ইচ্ছা সফল করতে পারেননি তিনি। অদ্বৈত মহাপ্রভু তার মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য যোগসাধনা বলে পৃথিবীর সমস্ত তীর্থের পূ্ণ্য জল এক নদীতে এক ধারায় প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। এই জলধারাই পুরোনো রেনুকা নদী বর্তমানে যা জাদুকাটা নদী নামে প্রবাহিত। বারেক টিলা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পশ্চিমে বড়ছড়া চারাগাঁও শুল্ক   স্টেশন। ভারত থেকে লরিতে করে কয়লা আমদানি হয় এখানে। এখান থেকে আরেকটু একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই খনি প্রকল্পটি এখন বন্ধ। এখনো এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খনির সরঞ্জামাদি। 
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন (০১৭১৪৫৩৭৯১৬), মামুন পরিবহনের (০১৭১১৩৩৭৮৫১, ০১৭১৮৪৩৮৭৩২) নন এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া এসি ৪০০-৫০০ টাকা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সড়কপথে সুনামগঞ্জের জেলা সদরের সঙ্গে সিলেটের বাস সার্ভিস আছে। সুনামগঞ্জ পৌঁছে শহরের সাহেববাড়ি ঘাট থেকে গুদারায় (পারাপারের নৌকা) আসতে হবে মনিপুরী ঘাট। ভাড়া জনপ্রতি দশ টাকা। সেখান থেকে মোটরসাইকেল কিংবা মেক্সিতে চড়ে আসা যাবে বারেকের টিলা। সারা দিনের জন্য একটি মোটর সাইকেলের ভাড়া পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা।  এ ছাড়া মোটরবাইকের একমুখী ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা। 
কোথায় থাকবেন
বারেকের টিলায় রাত যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই রাতে এসে অবস্থান করতে হবে সুনামগঞ্জ শহরে। সাধারণ মানের কয়েকটি হোটেল আছে শহরটিতে। শহরের ষোলঘর এলাকায় আছে সুরমা ভ্যালি রিসোর্ট (০১৭১১৪৩৮৮০৩, ঢাকা অফিস ০২-৯৮৮২০০০)। এ রিসোর্টের সবগুলো কক্ষই এসি। ভাড়া ১০০০-২০০০ টাকা। পুরাতন বাস স্টেশন এলাকায় হোটেল নূরানী (০৮৭১-৫৫৩৪৬, ০১১৯৬১৪২৯৩৯)। এ হোটেলের ভাড়া এসি একক ৫৭৫ টাকা, এসি দ্বৈত ৬৯০ টাকা, নন এসি কক্ষ ১৭০-৩৪০ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ২৮৫-৪৬০ টাকা। স্টেশন রোড পূর্ববাজারে হোটেল মিজান (০৮৭১-৫৫৬৪০)। ভাড়া এসি দ্বৈত কক্ষ ৬০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ১০০-২০০ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ১৮০-৩০০ টাকা। পুরাতন বাস স্টেশনে হোটেল প্যালেস (০৮৭১-৫৫৩৪১)। ভাড়া এসি দ্বৈত কক্ষ ৬০০ টাকা, নন এসি কক্ষ ৮০ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ১২০ টাকা।

লেখক: আলোকচিত্রও লেখা মোস্তাফিজুর রহমান

No comments:

Post a Comment